গান রিভিউ- জয়তী অধিকারী
কিছু নিলাম হওয়া স্বপ্ন
''এক মুঠো মেঘ, আমার আঙুলের আবেগ
ছুঁয়েছে কি তোমায়
অজানা রূপকথায়
আমার আভ্যন্তরীণ...
বৃষ্টি ভেজা প্রাণ, একরাশ অভিমান
খুঁজেছে কি তোমায়
আবছায়া নিরালায়
আমার আভ্যন্তরীণ...
কিসের কল্পনায়, কেন সব লেখা অস্পষ্ট
সময় অসময় খামখেয়ালী মুহুর্তে ব্যস্ত
বিষণ্ণ হৃদয়, নিরাপদ আশ্রয়
খোঁজে সারাদিনঅনাবাসী ভাষাহীন
আমার আভ্যন্তরীণ...
দিশাহীন সারা রাত, জেগে থাকা অজুহাত
খুঁজে ফেরে অমানিশা তোমার আমার ঠিকানা
সেখান থেকে আলোকবর্ষ দূর
এই নিশ্চিহ্নপুর, অন্তবিহীন।
কিসের কল্পনায়, কেন সব লেখা অস্পষ্ট
সময় অসময় খামখেয়ালী মুহুর্তে ব্যস্ত
স্বপ্নেরা ভাঙ্গে গড়ে, এসময় ঝরে পড়ে
সেই তোমার দুহাতে
ঘুম ভাঙা মাঝরাতে
আমার আভ্যন্তরীণ...
এক মুঠো মেঘ, আমার আঙুলের আবেগ
ছুঁয়েছে কি তোমায়
আবছায়া নিরালায়
আমার আভ্যন্তরীণ...
এক মুঠো মেঘ, এক মুঠো মেঘ, এক মুঠো মেঘ...”
এক বিষণ্ণ বিকেলে যখন টপ ফ্লোরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে মেঘেদের হাওয়ায় ভেসে যাওয়া দেখছিলাম, মনের মধ্যে অজান্তেই কখন যেন গুনগুন করে উঠেছিল ক’টা লাইন...
“বৃষ্টি ভেজা প্রাণ, একরাশ অভিমান
খুঁজেছে কি তোমায়, আবছায়া নিরালায়
আমার আভ্যন্তরীণ...”
আমাদের মনের বহু জটিলতার মধ্যে গুপ্তপ্রেম বোধহয় সবথেকে স্পর্শকাতর। কখন যে সে তিলতিল করে বেড়ে ওঠে আর কখন যে সে বাস্তবতায় ধাক্কা খেয়ে চুরচুর হয়ে ভেঙে যায়...কেউ বলতে পারে না। বড় একান্তে সে বেড়ে ওঠে নিজের মত করে। তাকে ঘিরে কোন সে কল্পনা ছায়াজাল বিস্তার করছে, কোন আবছায়া মূহুর্তে সে হয়ে উঠছে একান্তই আপন, সে’সব অনুক্ত কথা কি বুঝবে না অপরজন? যদি সে না বোঝে, অভিমানের পারদ যে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে এই গানটা তারই আয়না। না বলতে পারা কথা সুরের জালে জড়িয়ে অনায়াসে পৌঁছে দেওয়া যায় সেই অবুঝ মনের কাছে। আমি অ-সুর গোষ্ঠীর মানুষ। এ-মেজর, বি-মেজর, জি-শার্প মাইনর বা সি-শার্প মাইনর...এত কিছু বুঝি না। তাই, শুধুমাত্র কথা আর সুরের জাদুতে হারিয়ে যেতেই ভাল লাগে। গানের শেষেও সুরের রেশ রয়ে যায় গলায়, কানে, মনের গহীনে। বারবার শুনি আর ভাবি, গানটির রচয়িতা, কমলিনী কি করে জানল আমার মনের কথা! আর ‘সুরজিৎ ও বন্ধুরা’ ব্যান্ডের প্রাণপুরুষ সুরজিৎদাও যেন মনের সমস্ত আবেগ উজার করে সুর ঢেলে দিয়েছেন তাঁর সবথেকে প্রিয় বান্ধবীর কথায়। A perfect package বোধহয় একেই বলে।
“দিশাহীন সারা রাত, জেগে থাকা
অজুহাত খুঁজে ফেরে অমানিশা তোমার আমার ঠিকানা
সেখান থেকে আলোকবর্ষ দূর
এই নিশ্চিহ্নপুর...”
প্রতিটি লাইনে লুকিয়ে আছে আমার একান্ত নিজস্ব কিছু মূহুর্ত, কিছু ইচ্ছে, ভেসে যাওয়ার ইচ্ছে। ‘দিশাহীন সারারাত’ আঙুলের ডগায় এককুচি আবেগ নিয়ে তাকে স্পর্শ করার উদ্বেলতা... ‘আমার আভ্যন্তরীণ’। স্বার্থপরের মত ভাবতে ভালো লাগে এই গানটা কেবলমাত্র আমার, আমার জন্যে লেখা, আমার জন্যেই গাওয়া... ‘আমার আভ্যন্তরীণ’।
একটা গানের রেশ কাটতে না কাটতেই ‘সুরজিৎ ও বন্ধুরা’র আরও একটি অসাধারণ গান, যা বারবার শুনেও আশ মেটে না সেটি হল...
“চুপি চুপি তুমি অন্য আকাশে
এদিকে ভোর আসে যায়
ঝাপসা জুঁইফুল আবছা কুয়াশা
কিছু নিলাম হওয়া স্বপ্ন বুকে
পাড়ি দূর দূরে, অজানা দুপুরে
এখনো তোমায় ছাড়া পারব না
আমি পারব না, পারব না
এবারেও তোমায় ছাড়া পারব না
একে একে গ্রাম, একে একে মাঠ
একে একে পাড়া গাঁ যায় পেরিয়ে
গুড়িসুড়ি ভোর, নেমে আসে রোজ
ফেলে আসা ছবিগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে
অন্ধকার বাড়ে ধোঁয়াশায়
স্বপ্নমন হাওয়ায় উড়ে যায়
হয়ত বা কোনো মোড় ঘুরে
পাড়ি দূর দূরে, অজানা দুপুরে
এখনো তোমায় ছাড়া পারব না
আমি পারব না, পারব না
এবারেও তোমায় ছাড়া পারব না।
ষোলো আনা চাঁদ, আলো ঘেরা
রাতছায়া ছায়া স্মৃতি মেঘ যায় পেরিয়ে
পরবাসী মন, শিশিরে এখন
দেখেও দেখে না যায় প্রায় হারিয়ে
গল্প সেই শুনলে পুরোটাই
বর্ষাকাল হতাশার সময় তাই
কি যে করি পথ ক্রোশ খানেক
পাড়ি দূর দূরে, অজানা দুপুরে
এখনো তোমায় ছাড়া পারব না
আমি পারব না, পারব না
এবারেও তোমায় ছাড়া পারব না।
চুপি চুপি তুমি অন্য আকাশে
এদিকে ভোর আসে যায়
ঝাপসা জুঁইফুল আবছা কুয়াশা
কিছু নিলাম হওয়া স্বপ্ন বুকে...”
নিজের সবটুকু উজার করে দিয়ে কাউকে ভালোবাসার পর যখন দেখা যায় যে পুরোটাই অপাত্রে দান, তখনও তার জন্যেই মনটা আকুলি-বিকুলি করতে থাকে। ভালবাসার বিনিময়ে ভালবাসা ছাড়া আর কিছুর প্রত্যাশা না থাকলেও, প্রিয় মানুষটা যখন সত্যিই দূরে চলে যায়, কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না যে একসাথে কাটানো সময়গুলো আসলে টুকরো টুকরো নাট্যাংশ, একসাথে দেখা স্বপ্নগুলো কখন যেন নিলাম হয়ে গেছে! তবুও কি সেগুলো ভোলা যায়! তাই বার বার সুরজিৎদার সুরে সুর মিলিয়ে মন গেয়ে ওঠে …
“কিছু নিলাম হওয়া স্বপ্ন বুকে
পাড়ি দূর দূরে, অজানা দুপুরে
এখনো তোমায় ছাড়া পারব না
আমি পারব না, পারব না
এবারেও তোমায় ছাড়া পারব না”।
একে একে সবকিছু পেরিয়ে এসেও দেখা যায় ফেলে আসা সবকিছুই তাদের নিজেদের জায়গাতেই রয়ে গেছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে, স্মৃতি হয়ে। স্মৃতি…অবিনশ্বর। স্মৃতিরা ভালবেসে জীবাশ্ম হয়ে যায়, অতলে তলিয়ে গিয়েও কোথাও না কোথাও তবু থেকেই যায়। শুধু মানুষগুলোই রাস্তা মাপতে মাপতে পৌঁছে যায় অন্য কোন পথে, অন্য ঠিকানায়। একটা কষ্ট শুধু থেকে থেকে চিনচিন করে ওঠে বুকের এক কোণায়...
“ষোলো আনা চাঁদ, আলো ঘেরা রাতছায়া ছায়া স্মৃতি মেঘ যায় পেরিয়ে...”
সবকিছু পেরিয়েও কি সবকিছু পেরিয়ে আসা যায়! প্রশ্নটা অনুরণিত হতে থাকে গানটার প্রতিটি লাইনে। এক জাদুময় সুরের মূর্চ্ছণায় বারবার অবগাহন করতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে সেই অন্য আকাশে গিয়ে একবার অন্তত বলে আসি...
“এখনো তোমায় ছাড়া পারব নাআমি পারব না, পারব নাএবারেও তোমায় ছাড়া পারব না”।
কুর্নিশ সুরজিৎদা। এইভাবেই কিছু গান চিরদিনের হয়ে যায়। এইভাবেই কিছু গান শুধুমাত্র কারুর একান্ত নিজের হয়ে যায়। এই রকমই আরও কিছু চিরন্তন গানের সুরে ডুব দেবার অপেক্ষায় রইলাম।
মন ভরে গেল খুশি তে...। অসাধারন লেখা
উত্তরমুছুনamar oti priyo duti ganer osadharon review porlam. sarthok bishleshon.
উত্তরমুছুন