সিনেমা রিভিউ- অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়
সিনেমাঃ ক্লোজ্ড কার্টেন
পরিচালকঃ জাফর পানাহি
দেশঃ ইরান
সালঃ ২০১৩
সিনেমার মাঝামাঝিতে পরিচালক বাড়ি ফিরে আসেন। তিনি ইরান সরকারের গৃহবন্দী, তাই প্রতিবেশী খাবার দিয়ে যায় রোজ, কাঁচ সারাইওয়ালা তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে ভয় পায় এবং তিনি, বিকেলে একা জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখেন। তাঁর এই অচলাবস্থায় দমবন্ধ হয়ে আসে। ধীরে ধীরে হারাতে থাকে সিনেমার প্রতি উৎসাহ। এবং তখনই নিজের মোবাইলে একটি ভিডিও দেখে আবার কোমর বেঁধে নেমে পড়েন সিনেমার আঙিনায়। কি সেই ভিডিও? দর্শকেরা এতক্ষণে জানে।
‘ক্লোজ্ড কার্টেন’ শুরু এক বৃদ্ধকে নিয়ে। ইরান সরকারের হঠাৎ জারি করা কুকুর-নিধন ফরমান থেকে বাঁচাতে, পোষা কুকুরটিকে নিয়ে একটি বিচ হাউসে আশ্রয় নেয় সে। কে এই বৃদ্ধ? ইনি জাফর পানাহির স্ক্রিপ্টরাইটার। ঘটনাক্রমে, ক’দিন পর রাতে দুটি ছেলেমেয়ে পুলিশের থেকে পালিয়ে জানলা ভেঙে বাড়িটিতে ঢোকে এবং শত আপত্তি সত্ত্বেও মেয়েটিকে বৃদ্ধের হেপাজতে রেখে ছেলেটি পালিয়ে যায়। আর ফেরে না।
ধীরে ধীরে কুকুরটিকে কেন্দ্র করে মেয়েটির সঙ্গে বৃদ্ধের আলাপ গাঢ় হয়। কিন্তু হঠাৎই মেয়েটি এক সন্ধ্যায় উধাও। বৃদ্ধ অবাক। সে মোবাইল ক্যামেরায় উধাও হওয়ার আগের মূহূর্তটি অভিনয় করে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছিল, কিন্তু কোনো মাথা-মুন্ডু উদ্ধার করতে পারে না। পরদিন সকালে আচমকা মেয়েটি ফিরে আসে, কিন্তু অন্তর্ধান বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলে, সে বাড়িতেই ছিল। ইতিমধ্যে জাফর পানাহি ফেরেন এবং বোঝা যায় এটা তাঁর বাড়ি।
বৃদ্ধ মেয়েটিকে কোনো কিছুতে হাত দিতে মানা করেছিল। তাই পানাহি যখন দেয়ালের থেকে টান মেরে মেরে সাদা কাপড়গুলো সরাতে থাকেন, দেখা যায় এগুলো তাঁরই সিনেমার পোস্টার। সিনেমাগুলো ইরানে নিষিদ্ধ। এদিকে মেয়েটি তখন বৃদ্ধের কাছে জানতে চায়, কেন সে স্ক্রিপ্ট লিখছে! পানাহির তো সিনেমা বানানো নিষিদ্ধ! বৃদ্ধটি জানায়, সে অপারগ। তার কাজ শুধু লিখে যাওয়া। ওমনি নিমেষে বোঝা যায় এই চরিত্রদুটি আসলে পানাহির দুই অল্টার ইগো। একজন সিনেমা না বানিয়ে থাকতে পারে না, আর আরেকজন ক্রমাগত আঘাতের মুখে সিনেমার প্রতি ভালোবাসা হারাতে শুরু করেছে।
শুরুতেই একটা ভিডিওর কথা বলা হয়েছিল। ভিডিওটি মোবাইল ক্যামেরায় রেকর্ড করা বৃদ্ধের অভিনয়। প্রথমবার তা সিনেক্যামেরায় দেখা গিয়েছিল, এবার খোদ মোবাইল ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলে। ভিডিওটিতে বৃদ্ধের অভিনয় চলতে চলতে হঠাৎ দেখা যায় পানাহি তাঁর দুই অ্যাসিসট্যান্টকে নিয়ে সে দৃশ্য শুটিং করছেন। তাঁদের শুট করা দৃশ্যই শুরুতে দেখেছেন দর্শকেরা। পানাহি ভিডিওটিকে ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে দ্যান, যেখানে আস্তে আস্তে সমুদ্রে নেমে যাচ্ছেন তিনি। হঠাৎ পজ বাটন টেপেন, এবং ভিডিওটিকে ব্যাকওয়ার্ড চালান। মনে হয় তিনি যেন সমুদ্র থেকে ফিরে আসছেন। সিনেমাটা শেষ হয় পানাহি যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই গাড়ি করে তাঁর চলে যাওয়া নিয়ে। শুধু এবার তাঁর সিনেমার পোস্টার কোনো কাপড়ে ঢাকা থেকে না।
‘ক্লোজড কার্টেন’ একটি সম্পূর্ণ নতুন ঘরানার সিনেমা। এখানে বাস্তব, কল্পনা আর অতিবাস্তব ইচ্ছেমতো একে অপরের মধ্যে পাল্টাতে থাকে। পানাহি আর সব কিছু ছেড়ে নিজের ইমেজকেই সবরকম নিষিদ্ধতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। সিনেমার পোস্টারের উপর থেকে কাপড় সরানো, নিজের শ্যুটিং করার দৃশ্যকে প্লটে ঢুকিয়ে দেওয়ার মধ্যে সেই চ্যালেঞ্জ ঠিকরে পড়ে, যা চিরকাল সরকারী বাঘনখের সামনে শিল্পীকে অনমনীয় করেছে। সিনেমাটিতে যেভাবে ‘সিনেমা’কে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাও অসম্ভব আকর্ষণীয়।
২০১০ সালে সরকারী নিষিদ্ধতা জারির পর, পানাহি ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’ সিনেমাটি কেকে লুকিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়েছিলেন। ‘ক্লোজড কার্টেন’ও সরকারী রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বার্লিনে সিলভার বিয়ার জিতেছে। তাই আমাদের দেশে চিত্রপরিচালকেরা যখন সরকারী নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে শিল্পকে গুটিয়ে নেন, সেই শিল্পকে খেলো আর হাস্যকর মনে হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন