২৫ এপ্রিল ২০১৫

সিনেমা রিভিউ১-সোহম চক্রবর্তী

সিনেমাএডউড
পরিচালক – টিম বার্টন
ভাষা – ইংলিশ 


এডওয়ার্ড ডি. উড জুনিয়র। সংক্ষেপে এড উড। পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট পরিচালক। এরকম খেতাবপ্রাপ্ত একজনের জীবনের ওপর সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন বর্তমান কালের হলিউডের এক অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাতা টিম বার্টন। এড উডের নাম কেউ শুনে না থাকলেও টিম বার্টনের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। বিখ্যাত মাইকেল কিটন অভিনিত ব্যাটম্যানসিরিজের (১৯৮৯-৯০) পরিচালক ছাড়াও টিম বার্টনের ঝুলিতে আছে আরো অনেক সাড়া জাগানো ছবি। যেমন Edward Scissorhand, Charlie and the Chocolate Factory, Planet of the Apes, Sweeny Todd, ইত্যাদি। এরকম স্বনামধন্য নির্দেশক হঠাৎ পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট পরিচালকের খেতাবপ্রাপ্ত একজনের জীবন নিয়ে সিনেমা কেন করতে গেলেন? কী উদ্দেশ্য ছিল তার? শুধুই কী একটা হাইপের সম্ভাবনা মাথায় রেখে? মনে হয় না।


 টিম বার্টনের সিনেমা ক্যাটালগে নজর রাখলে দেখতে পাবেন তাঁর সিনেমাগুলি ঠিক সাধারণ হলিউডি সিনেমার মতো নয়। প্রত্যেকটা সিনেমাতেই গল্পটা realism থেকে সরে magic reality-এর একটা জায়গায় এসে পৌঁছয়। টিম বার্টনের যারা ফ্যান তারা ঠিক এই কারণটার জন্যেই ওনার ফ্যান। টিম বার্টন হয়তো এড উডের সিনেমার মধ্যেও অতিপ্রাকৃতের প্রতি ওনার আকর্ষণটা উপলব্ধি করেন। বস্তুত, এড উডের যে কিঞ্চিৎ পরিমাণ সিনেমা জনসাধারণের সম্মুখে (পড়ুন বক্স-অফিসে) এসেছিল, সেগুলি সবই সেই ঘরানার সিনেমা। যারা আমরা সিনেমা দেখি বা ভালোবাসি, তারা জানি যে এই ঘরানার সিনেমা খারাপ তৈরী হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে বেশী। টিম বার্টনের মতো এই ঘরানায় প্রসিদ্ধ একজন চলচ্চিত্রকারের হাত দিয়েও বেরিয়েছে Mars Attacks! বা Dark Shadows-এর মতো নিম্ন জাতের ছবি। টিম বার্টন ভালো করেই জানেন যে পথে তিনি হাঁটেন তা কতটা পিচ্ছিল, এবং সেই পিচ্ছিলতায় পা ফসকে আলুর দম হয়ে যাওয়া কতটা সহজ। তাই হয়তো তাকে টেনেছিল এমন একজনের জীবনী যে এই পা ফসকে সবথেকে মুখরোচক আলুর দমটি হয়েছেন। সাইকোলজিক্যালি হয়তো একটা চরম ভীতিও কাজ করে থাকতে পারে স্বনামধন্যতার বিপরীতে অবস্থিত মেরুটার প্রতি। তাই সেখানে বিরাজমান ব্যক্তিটির জীবনে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন টিম বার্টন। বস্তুত, এটি টিম বার্টনের প্রথম দিকের সিনেমা। তাই এই ভীতি তখন ওনার মধ্যে কার্যকর থাকার সম্ভাবনা প্রভূত কিন্তু সেই বিপরীত মেরুতে অবস্থিত প্রাণীটির জীবন কি সত্যিই বড় করুণাময় ছিল। এড উড যা অর্জন করতে পারেননি তা নিজস্ব নির্গুণতার কারণেই পারেননি। তার সিনেমায় কন্টিন্যুয়িটির কোনও মা-বাপ থাকত না। ভয়ংকর দুর্বল সেট ডিজাইন। তার নিজস্ব ‘ম্যাগনাম ওপাস’ Plan 9 From Outer Space সিনেমায় কাগজের প্লেট সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে সেটাকে ফ্লাইং সসার বলে দেখানো। এড উড সিনেমাটা দেখে যতদূর মনে হল উনি জীবনে কখনও কোনও রিটেক করেননি। এই হতশ্রী নির্দেশনার কারণে তার লব্ধ খেতাবটা হয়ত সত্যিই প্রাপ্ত। কিন্তু তাই বলে তিনি জীবনে যে একটি সর্বনিকৃষ্ট মানুষ ছিলেন তা মোটেই না। বরং তার মধ্যে ছিল প্রকৃত বন্ধুত্বের সর্বপ্রকার গুণাবলি। বেলা লুগোসি বলে হাঙ্গারিয়ান অভিনেতা (ইনি ১৯৩১ ড্রাকুলা খ্যাত) তার অন্তিমকালে যখন ডুবন্ত সূর্যের গ্লানিতে জর্জরিত, তখন ঘটনাচক্রেই আলাপ হয়ে যায় তার এড উডের সঙ্গে। এড উড ওনাকে অবশ্যই তাঁর সিনেমার অর্থসংগ্রহের টোপ হিসেবে ব্যবহার করত (যদিও সেই সময় লুগোসি অভিনয় করছেন দেখিয়ে টাকা সংগ্রহ করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল)। কিন্তু ওনার শেষ বয়সের একমাত্র সঙ্গীও ছিলেন তিনি। লুগোসির মরফিনের নেশার সেই শেষ দিনগুলোতে উড ছিলেন তার একমাত্র বন্ধু। উড চেষ্টাও চালিয়ে গেছেন লুগোসিকে অভিনয়ের জগতে ফিরিয়ে আনার জন্য।


 এছাড়াও উডের পার্সোনাল লাইফ ছিল একেবারেই আলাদা। যে বৈশিষ্ট্যটি নজর কাড়ে সেটা হল ওনার Transvestism,  অর্থাৎ উনি মহিলাদের পোষাক পরতে পছন্দ করতেন। টিম বার্টনের ছবিতে আমরা এও দেখতে পাই যে উনি যখন stressed অনুভব করতেন তখন উনি মহিলাদের পোষাক পরে নিজের anxiety দূর করতেন। কখনও কখনও উনি সেই পোষাকেই পরিচালনা করতেন। কিন্তু তিনি বরাবরই নারীদের প্রতিই আসক্ত ছিলেন এবং তাঁর গার্লফ্রেণ্ডকে যথেষ্ট ভালোও বাসতেন। ওনার প্রথম সিনেমা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে (১৯৫৩) ‘Glen or Glenda’ তার নিজস্ব এই transvestism-এর উপরেই। বলাই বাহুল্য, সেই সময়ে হলিউডে এই বিষয় নিয়ে সিনেমা বানানো ভাবনার বাইরে ছিল যে কোনও নির্দেশকের। উড যদি নিকৃষ্টতম ডিরেক্টর না হতেন তাহলে হয়তো আমরা ওনাকে এখন এই বিষয়ে বানানো প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে মনে রাখতাম (সর্বপ্রথম কিনা সঠিক আমার জানা নেই)। এই মহিলাদের পোষাক পরাকে কেন্দ্র করে ওনার প্রথম গার্লফ্রেণ্ডের সাথে ওনার বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু পরবর্তী গার্লফ্রেণ্ড এই বিষয়টাকে মেনে নেয় এবং তাঁরা দু’জন বিয়েও করেন।


 উডের জীবনকে দেখার চোখ ছিল একেবারেই আলাদা। অনেকটা বালকের মতো, সবকিছুতেই একটা স্বাভাবিক বিস্ময় ভরা। এ ছাড়া তিনি ছিলেন চূড়ান্ত আশাবাদী। চতুর্দিক থেকে ওনার ছবি, গল্প, চিত্রনাট্য নিন্দিত হওয়ার পরেও উনি বিচলিত হতেন না। সর্বদা মনে করতেন যে পরবর্তী সিনেমা হিট করবে এবং তিনি বন্দিত হবেন ওনার মানসগুরু অরসন ওয়েলেসের মতো। নিজেকেও ওনার মতো চিত্রনাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা হিসেবে দেখতেন উড। এই আশাবাদীতার কারণে বাস্তব থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতেন উড। তবুও খারাপ ছবি করার নিশ্চয়তার মতোই ওনার আশেপাশে একটা নিশ্চিত বন্ধুদের দল সবসময় ছিল। ছবির টাকা জোগাড়ের জন্য উড নিজের আত্মসম্মানের তোয়াক্কা করতেন না। বস্তুত, তাঁর আত্মসম্মান জ্ঞান ছিল অপ্রতুল। তাঁর কাছে সিনেমা বানানোটাই মোক্ষ ছিল, যেন তেন প্রকারেণ। সেদিক দিয়ে দেখতে হলে সিনেমার প্রতি একনিষ্ঠাবান ছিলেন তিনি। কিন্তু চলচ্চিত্রের যে শিল্পকলা তা শেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি কোনদিনই। করলে হয়তো তাঁকে নিয়ে এই সিনেমাটা কোনদিনই বানাতেন না কেউ। তিনিও মাঝারি মাপের অচেনা অজানা কোনও নির্দেশক হিসেবে রয়ে যেতেন।
 উড স্টক ফুটেজ প্রভূত পরিমাণে ব্যবহার করতেন তার সিনেমায়। টিম বার্টনের সিনেমা দেখে যা বোঝা যায় তা হল উডের ট্যালেণ্ট ছিল অন্য জায়গায়। সেটা হল প্রোডাকশনে।  উনি জোগাড় করতে ওস্তাদ ছিলেন। তাই বারবার আটকে পড়া সত্ত্বেও উনি সিনেমা বানাতে সক্ষম হয়েছেন। সেটি ওনার প্রযোজনার জোরেই। যদি উনি আরো উপরতলার লোকজনদের চিনতেন তাহলে হয়ত তার সেট আরো ভালো হতো। কিন্তু তাকে স্টুডিও থেকে প্রপ চুরি করে ব্যবহার করতে হত। কারণ বাজেট সবসময় সীমিত থাকত। উঠতি নির্দেশকেরা এই সিনেমাটা থেকে অনেককিছুই রিলেট করতে পারবে এই সূত্রে। কীভাবে কম বাজেটের মধ্যে সিনেমা করা, স্টক ফুটেজ দিয়ে সিনেমা বানানো, টাকা জোগাড় করার প্রচেষ্টা, এই সবকিছুই যে কোন উঠতি অনামী চলচ্চিত্রকারের জীবনের অংশ। রিভিউয়ের শেষে বলতেই হয় যে টিম বার্টন একটি অনবদ্য কাজ করেছেন। সিনেমা শৈলীর মধ্যে আমরা পরবর্তী পরিপক্ক টিম বার্টনের ছায়া ভালোভাবেই দেখতে পাই। ওনার সেন্স অফ হিউমার অনন্য। সেই হিউমার এই ছবিতেও বর্তমান। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে ছবি বানানো, যদিও তার সহযোগীতায় ছবিকে নিরানন্দ ম্লান লুক দেওয়ার কোনও অপপ্রচেষ্টা করেননি বার্টন। ছবিটা কখনই কোনও দুঃখের সন্ধান করে না, শুধুমাত্র লুগোসির জীবনে ছাড়া। উডের যতটুকু জীবন দেখানো হয়েছে তাতে দুঃখের লেষমাত্র নেই। এও একধরনের শিক্ষা হয়ত। যে সমাজ আমাদের শিখিয়েছে যে পরিচিতি পাওয়ার মধ্যেই শ্রেষ্ঠ সাফল্য, উডও নিশ্চিত সেই সমাজেরই একজন ছিলেন। তিনিও পরিচিতি পেতে চেয়েছিলেন। পাননি। কিন্তু তাতেই কি তাঁর জীবন অসফল হয়ে গেল। টিম বার্টন সরাসরি না হলেও এই প্রশ্নটা করে দিয়ে গেছেন তাঁর এই ছবিতে। উডের জীবন আমরা কিন্তু হাসিখুশি হিসেবেই দেখি। কোথাও কখনও দুঃখের ছায়া পাই না। টাকা জোগাড় না হওয়ার টেনশনের মধ্যেও না। এরকম ভাবে বেঁচে থাকতে পারার মধ্যে কি কোনও সাফল্য নেই? এভাবে বেঁচে থাকতে পারাটাই কি সাফল্যের চূড়ান্ত মাপকাঠি হতে পারে না? এই প্রশ্নগুলোই এসে ভিড় বসায় সিনেমাটা শেষ হওয়ার পর। আর কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মুখে একটা সুন্দর হাসি এসে যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন