২৫ এপ্রিল ২০১৫

বই রিভিউ-অনির্বাণ ভট্টাচার্য

নবারুণ ভট্টাচার্য – কথাবার্তা সংগ্রহ (ভাষাবন্ধন ২০১৫) ; একটি রিভিউ



‘ওড়াটাই তো সাবভার্সিভ...’ । ভাষাবন্ধন প্রকাশিত ‘কথাবার্তা সংগ্রহ ; নবারুণ ভট্টাচার্য’ ঘাঁটতে গিয়ে মনে হল কলকাতা বইমেলা ২০১৫ স্মরণীয় হয়ে থাকলো না থেকেও ভীষণভাবে বেঁচে থাকা একমুখ দাড়িগোঁফ মানুষটার উপস্থিতি । মনে হচ্ছিল এবারেও অভ্যেসমতো কেনার পর কিছু লিখতে বলে দিই ভাষাবন্ধন স্টল আলো ক’রে বসে থাকা লেখককে । কিন্তু তা আর যখন হওয়ার নয়, অগত্যা – দেখি নবারুন-দা, (যদিও এ নামে কোনোদিন ডাকার স্পর্ধা হয়নি তাঁকে) আপনার কোন কথাগুলো এযাবৎ মিস করে গেছি আমি । সত্যিই ‘সংগ্রহ’ – কী কী নেই সঙ্কলনটিতে – বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, সেন্সরশিপ, নন্দীগ্রাম, পোস্টমডার্নিসম, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, লেখকের গদ্য-পদ্য এবং সাহিত্যজীবন, সবকিছুই এসেছে । সাক্ষাৎকারগুলির সাথে লেখকের কয়েকটি ছড়ানোছেটানো আত্মকথন জুড়ে দিয়ে রীতিমত প্রশংসার দাবি রেখেছে বইটি । কথোপকথনগুলির শিরোনাম হিসেবে নবারুণেরই কিছু চাবুক মারা কথা দিয়ে সুচীপত্র সাজানো – মনে হল নবারুণ উঁকি মারছেন – অনেকটা সিনেমায় চিঠি পড়ার মতো – পাঠকের মৃদু কণ্ঠস্বর থামিয়ে ভেতর থেকে চিঠি পড়ছে সেই চিঠির লেখক - এক্ষেত্রে বক্তা নবারুণ – ‘নিজেকে প্রান্তিক ব’লে মনে করি ...’, ‘একটা অ্যাবসার্ড পৃথিবী এসে পড়েছে’, ‘প্রত্যেককে একটা স্ট্রাটেজি ঠিক করতে হয়’ এবং আরও কত কথা । বোঝা যায় ইন্টার্ভিউ–এর ওপারে বসে প্রশ্নকর্তা টোকা মারছেন আর এপারের লোকটা একে একে খুলে দিচ্ছেন আলো-অন্ধকারের দরজাগুলো ।

নবারুণ স্পষ্টবাদী । তাই বলতে পারেন মায়ের থেকে তিনি কোনোভাবেই ইন্সপায়ার্ড নন । নবারুণ খোলামেলা । তাই শ্রীলঙ্কার ট্রটস্কাইট জেভিপি-দের উত্থানকে মুক্তকণ্ঠে সমর্থন করেন । নবারুণ সোজাসাপটা । তাই বলেন, যে শহরের দুঘণ্টা দূরে মানুষকে কুমীরে টেনে নিয়ে যায়, সেখানে ‘পোস্টমডার্নিসম হ্যানাত্যানা...’ জাস্ট বিলাসিতা মাত্র । নবারুণ ডোন্ট কেয়ার । তাই ঘোষণা করেন টেলিভিশন ‘universal corrupter... greatest prostitute’ । সবকটি সাক্ষাৎকারই মেদহীন, ঋজু, তবে আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায় (১৯৯৪) দেবেশ রায়ের সাথে লেখকের কথোপকথন, ‘অনুবাদ ও ভাষাবন্ধন’ শীর্ষক অপ্রকাশিত আলোচনাটি প্রশ্নকর্তা যেখানে রাজীব চৌধুরী ও ভাস্কর ঘোষ, ‘লিপি নাগরিক’এর ‘নবারুণের সাথে কিছুক্ষন’ এবং ঐহিক পত্রিকায় নবারুণের লেখা ‘মিথ্যে ভাঙ্গার ভাষা’ (২০১৩)। নবারুণের চৌহদ্দি ঘুরতে ঘুরতে বোঝা যায় হারবার্ট একটা ‘দার্শনিক অবজারভেশন’, ফ্যাতাড়ু ‘উইশ ফুলফিলমেন্ট’ আর ‘মৃত্যু উপত্যকা...’ বরানগর-বারাসাতে খুন হয়ে যাওয়া আট আটটা ছেলের প্রতি এক কবির কিছু করতে না পারা বিবেক । এসেছে স্ল্যাং প্রসঙ্গ । প্রান্তিক মানুষদের মুখে আর কী ভাষা বসানো যেতে পারে? প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন নবারুণ - ‘আমি নিজেই তো প্রান্তিক’ – নির্লিপ্ত উচ্চারন লেখকের । এসেছে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ । একদিকে যেমন চির-বামপন্থী নবারুণ – ‘এই আমেরিকাকে বিশ্বাস করার কোনও কারণ ঘটেনি...’ অন্যদিকে নিজের রাজ্য নিয়েও রয়েছে স্যাটায়ার ‘৩৪ বছরের বাম শাসনে শুধু পার্টিক্র্যাসিই হয়েছে...’ । খুব সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারগুলি থাকলে অবশ্য আরও কিছু যুক্ত হত (পাঠক যা বোঝার বুঝে নিন)। তবে শেষমেশ ভীষণ আশাবাদী লেখক । ‘ভালো লেখা হচ্ছে শুধু না, দাবড়ে হচ্ছে’, ‘হারবার্টরা থাকবে এবং আছে’, ‘গরীব মানুষের.....খেলা চলছে-এখনই হেরে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি’ লেখকের সাহসী ঘোষণা । এ বই নবারুন-ভক্তদের সোনার খনি । প্রতিটি লেখা আলাদা ক’রে ধরলে এবং অবশই সামগ্রিকভাবে ।


দুএকটি ক্ষেত্রে প্রশ্নচিহ্ন রয়েই গেছে যদিও । যেমন বইটির শেষে সামগ্রিকভাবে সাক্ষাৎকারগুলির কালানুক্রমিক সূচি দেওয়া আছে । অথচ প্রথমেই কালানুক্রমিক ভাবেই লেখাগুলি কেন যে সাজানো হল না – প্রশ্ন থেকে গেল । সেক্ষেত্রে পাঠকদেরই সুবিধে হতো লেখকের ক্রমিক অবস্থানটা ধরতে । ভূমিকাতেই বলা হয়েছে আরও কিছু সাক্ষাৎকার বাকী থেকে যাওয়ার কথা, যা অদূর ভবিষ্যতেই প্রকাশ পাবে । খুশীর খবর । তবে এটুকু বলা যেতে পারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কথাবার্তা সংগ্রহ’ লেখকের মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর বেরোনোয় সঙ্কলনটি সামগ্রিকভাবে একটি খণ্ডেই প্রকাশিত হয়েছিল । সেটির আকার বড় হলেও পাঠকের কাছে সুবিধাজনক হয়েছিল । এক্ষেত্রেও নবারুণের বক্তব্যগুলিকে কিছুদিন পরে একটি খণ্ডেই সঙ্কলিত করা হলে বেশ হত ।

যদিও এহ বাহ্য, এসব ছোটোখাটো জিজ্ঞাসার চিহ্ন পেরিয়ে যে রাস্তায় নবারুণের কথাবার্তা সংগ্রহের পাঠক এর মধেই এসে পড়েছেন – তা থেকে বেরনোর রাস্তা নেই । বললাম না - ‘প্রত্যেককে একটা স্ট্রাটেজি ঠিক করতে হয়’ । প্রিয় পাঠক, এবার আপনিই ঠিক করুন আপনার স্ট্রাটেজি কী হবে, একরাতেই শেষ করবেন, নাকি একটু একটু করে হেঁটে যাবেন নবারুণের সোজা কথাকে সোজা ভাবে বলার পৃথিবী-তে ।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন