কবিতা রিভিউ- মিলন চট্টোপাধ্যায়
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা এবং আমার ভাবনা
যখন বৃষ্টি নামলো
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
বুকের মধ্যে বৃষ্টি নামে, নৌকা টলোমলো
কূল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনও সম্বল
নেই নিকটে – হয়তো ছিল বৃষ্টি আসার আগে
চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, তাই কি মনে জাগে
পোড়োবাড়ির স্মৃতি ? আমার মধ্যে স্বপ্নে-মেশা দিনও ?
চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, চলচ্ছক্তিহীন।
বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠান পানে একা
দৌড়ে গিয়ে, ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা
হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে – অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে।
খুব কষ্ট পেলে বুকে নামে শ্রাবণ। হূহূ হাওয়া দেয়। ভিজে যাই অবিরাম। তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতা আশ্রয় হয়ে ওঠে। বৃষ্টি নামছে; কোথায়? নামছে বুকের মধ্যে। নৌকা টলোমলো কেন? কে আছে সেই নৌকায়, কেন ভারসাম্য নেই? চলচ্ছক্তিহীন হয়েছেন বলে? কবি স্থবির, তাকে ঘিরে ধরেছে এ কোন্ দহন? বৃষ্টি আসে দহনের পরেই। গতি, উর্বরতার প্রতীক হয়ে। জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ধূধূ উষর প্রান্তর, দগ্ধ গাছ যেভাবে প্রতীক্ষা করে জলধারার কবিও তেমনই প্রতীক্ষায়। বৃষ্টি কখন আসবে;শুরু হবে বপনের উৎসব। ডমরুর মত ভেসে আসবে আওয়াজ। কবি লিখছেন -
"কূল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনও সম্বল
নেই নিকটে – হয়তো ছিল বৃষ্টি আসার আগে..."
এই লাইন আমাকে দাঁড় করায় এক অদ্ভুত প্রশ্নের সামনে - কূলে যেতেই তো সম্বল লাগে, এ কেমন অকূল যেখানে সম্বলের কথা আসে! কেন লিখলেন কবি এই লাইন? অকুলে যেতে তো সম্বল লাগে না, নাকি এ সেই মৃত্যুচেতনা যা আদিকাল থেকে পারানির কড়ি খুঁজে চলে। কবি যেতে চাইছেন কূলহীনতায় অথচ তাকে গ্রাস করছে পোড়োবাড়ির স্মৃতি। পুড়ে যাওয়া আশ্রয়কে রোমন্থন করা কেন? দহনের সময় সেই বাড়িতে কে ছিল? সে কি কবির প্রিয়জন নাকি কবি নিজেই? নিজে হাতেই কি বহ্নিচিতায় মিশিয়েছেন বাড়ি? এই বিষণ্ণতা বাড়ির ভেতরে থাকা কোন বাড়ির। যা আস্তে আস্তে মিশে যাবে কালের গহ্বরে।
কবি যেন সেই মানুষ যিনি দাঁড়িয়ে আছেন আগুনের ঘেরাটোপে! অপেক্ষা করছেন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে কখন নামবে বৃষ্টি। যখনই সেই বৃষ্টি নেমে আসছে কবি ছুটছেন কাউকে দেখতে চেয়ে। কোথায় সেই প্রার্থিত মানুষ ? মেঘে বৃষ্টিতে মিশে কেন শিউলিগাছের তলায় সে আসতে পারে! শিউলি গুল্ম, বৃক্ষ নয়। ফুল আরও আছে তবু শিউলিই কেন! নাকি মগ্ন চৈতন্যর রঙে মিশে যায় শিউলির সাদা আর কমলা? এই ভিজে যাওয়া আসলে শুদ্ধতার প্রতীক, শিউলি ফুলের মত সাদা। কবি শুদ্ধ করছেন অন্তরাত্মাকে আকাশ ছেঁচা জলে। আজানুকেশ রূপক হলেও সে বিদিশার নিশা নয়, তাকে ধরা ছোঁয়া যায়। এখানেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ক্যারিজমা। শরীরহীন চৈতন্য হয় না। আর কবির পুড়ে যাওয়া আত্মার দহন, পোড়োবাড়ি এই শরীর। যা শান্ত হয়ে যাচ্ছে অশ্রুপাতে। কাঁদতে না পারার যন্ত্রণাই কবিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল আগুনের ঘেরাটোপে। সে জন্যই এই লাইন -
"কিন্তু তুমি নেই বাহিরে – অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে।"
যা বাইরে নেই, অন্তরে আছে। যা ব্যাপক বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে শুদ্ধতার দিকে।
একবৃষ্টি মুগ্ধতা
উত্তরমুছুন