২৬ এপ্রিল ২০১৫

সম্পাদকীয়

আমরা অনেকেই পড়ি, আবার লিখিও। কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস। কিন্তু সেগুলো নিয়ে আলোচনা তো দেখায় যায় না। এমনকি সিনেমা, খেলা এগুলো নিয়েও। সেই ভাবনা থেকেই 'রিভিউ' সংখ্যার কাজ শুরু করা হল। কিন্তু কাজ করতে স্পষ্ট আমরা কেন 'রিভিউ' লিখিনা। শুধুই কি আলস্য? আসলে আলসেমি আমাদের কাছে তৃতীয় হাত হয়ে দাঁড়িয়েছি। সেই হাত দিয়ে আমরা ক্রমশ ধ্বংস করে চলেছি নিজের পরিধি। ভাবনা, চিন্তা, নিজস্ব মতামতের পরিধি।


আলগা আর আলস্য এর মধ্যে একটা যোগ আছে। আসলে আমরা যখন কিছু পড়ি বা দেখি তখন  যদি সেটার ভিতরে না ঢুকতে পারি তাহলে আমরা সেটার 'রিভিউ' লিখতে পারব না। এই আলগাভাবে নেওয়াটাকে আমরা আলসেমি বলে চাইছি কি? আর একটা ব্যাপার ভিতরে ঢুকে যাওয়া মানে একটা কম্পন অনুভব করা। এই কম্পনটা বোঝার জন্য কোন সিসমোগ্রাফের প্রয়োজন হয়না। অনুভব আর অনুভূতি।


'রিভিউ' সংখ্যাটিরও একটি রিভিউ দেওয়া হল 'রিভিউয়ের রিভিউ'। আমরা আরও 'রিভিউ' এর অপেক্ষায় থাকলাম।


'টিম তবুও প্রয়াস' এর তরফ থেকে গতকাল ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে নিহত ও আহত সকলের প্রতি সমবেদনা রইল। 


'সকলের তরে সকলে আমরাপ্রত্যেকে আমরা পরের তরে' ।।

রিভিউয়ের রিভিউ - তন্ময় ভট্টাচার্য্য

মাস্টারি – তবুও প্রয়াস

এ যেন খোদার ওপর খোদকারি। স্কুলে একবার মনিটরদের ওপর নজর রাখার জন্য ক্লাসটিচার আমায় নিয়োগ করেছিলেন, বেচাল দেখলেই নালিশ। আজ প্রায় বছর দশেক পর সম্পাদকমশাই’এর কাছ থেকে সেই গুরুদায়িত্ব পেয়ে যাহাপরনাই আহ্লাদিত বোধ করছি। পুরো বই পড়ার বদলে প্রফেসর’রা যেমন পাশ করার জন্য টু-দ্য-পয়েন্ট নোট বানিয়ে দেন, সেরকমই সারমর্ম বলা যেতে পারে লেখাটিকে। পাশ হয়তো করতে পারবেন এটি পড়ে, কিন্তু গভীরে যেতে হলে পুরো পত্রিকাটির পঠন অবশ্যকাম্য।


সম্পাদকীয়’তে লেখা হয়েছে – “আলগা আর আলস্য - এর মধ্যে একটা যোগ আছে। আসলে আমরা যখন কিছু পড়ি বা দেখি তখন যদি সেটার ভিতরে না ঢুকতে পারি তাহলে আমরা সেটার 'রিভিউ' লিখতে পারব না” এই ভেতরে ঢোকার কর্মটি একেকজনের কাছে একেকভাবে ধরা দেয়। কেউ অনুভূতির প্রাবল্যে জারিত হন, কেউ বা খোসার পর খোসা ছাড়িয়ে গোড়ায় না পৌঁছলে তৃপ্তি পান না। সমালোচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুষ্টিযোগের সমতুল্য হয়ে ওঠে, আর নিরীহ লক্ষ্যটি ভাগ্যের হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে ঝুলে থাকেন মাংসের দোকানের পাঁঠার মতো। ভালো সমালোচক পাওয়া নোবেলপ্রাপ্তির সমতুল্য। কোটিতে একজন। কিন্তু তিনি যে আদর্শ রেখে যান আগামী’র কাছে, তা দশকের পর দশক ধরে সমাদৃত হয়। বাংলা সংস্কৃতি’র চরম সৌভাগ্য যে বুদ্ধদেব বসু’র মতো ব্যক্তি’র স্পর্শ লাভ করেছিল।


আলোচনায় ফিরি। পত্রিকার নাম – ‘তবুও প্রয়াস’। কীসের প্রয়াস? কেনই বা এই প্রয়াস? শর্টকাটে কাজ হাসিল করার জমানায় প্রয়াস আবার কেউ করে নাকি? তাহলেই তো একের পর এক সূত্র ধরে বেরিয়ে আসবে জটিলতা। সাফল্য অনেক পরের কথা। আমরা জোড়াতালি দিয়ে কোনোক্রমে টিকিয়ে রাখতে পারলেই নিজেদের ধন্য মনে করি। তাহলে?

সব এলাকাতেই কিছু দামাল তরুণ থাকে, গতানুগতিকের থেকে আলাদা, যারা স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মাঝে দুলতে দুলতেও বের করে নেয় নিজস্ব রাস্তা। তাদের স্বপ্ন ও লক্ষ্যের মুখপত্রই যদি হয় এই পত্রিকা, ক্ষতি কি? স্থিতিশীলতার থেকে গতি সবসময়ই বেশি আদরণীয়। সেই সংযত উদ্দামতার প্রয়াস। বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার। যা প্রয়াস ছাড়া এই সংকটের দিনে সত্যিই অসম্ভব।


(১)

ভিশ্যুয়াল ইন্টারপ্রিটেশান কী? খায় না মাথায় দেয়? ভাবতে ভাবতে স্ক্রিনে ফুটে ওঠে একটি ছবি। মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলি’র তৈরি। একটি কবিতার একটি ছবির মাধ্যমেই দৃশ্যায়ন। তা আবার কীভাবে সম্ভব? জানতে গেলে দেখতে হবে। অনুভূতি কখনো কখনো বর্ণনাতীত হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র তখনই তা কিছুটা এগিয়ে যায় অমরত্বের পথে। ঝাপসা ও বিপর্যস্ত পটভূমির মধ্যে থেকে একটি হাত আড়াল করতে চাইছে গোপনাঙ্গ, ব্যথায় ও লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছে তার চামড়া। পাশেই দুটি শ্বেতশুভ্র প্লেটে কর্তিত স্তন, আভাস দিচ্ছে ক্ষুধা ও লালসার। কলঙ্কিত পৌরুষের ইঙ্গিত কাঁটাচামচ আর ছুরির ইঙ্গিতে। বাকিটা ব্যক্তিগত...


(২)

‘এডউড’ নামক একটি সিনেমার রিভিউ করেছেন সোহম চক্রবর্তী। সিনেমাটি এডওয়ার্ড ডি. উড জুনিয়র নামক এক পরিচালকের জীবনী। যাকে বলা হয় পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পরিচালক। তার হয়ে ওঠা, যাপন, বন্ধুত্ব, ব্যর্থতা ও পরিহাসময় যাত্রা অদ্ভুত সৌন্দর্যে ও সাবলীলতায় উঠে এসেছে সোহম চক্রবর্তীর বর্ণনায়। ভিশ্যুয়াল বিষয়ের লিখিত রূপ দেয়ার জন্য যে মুন্সিয়ানার পয়োজন, তাতে সন্দেহ নেই। “উডের যতটুকু জীবন দেখানো হয়েছে তাতে দুঃখের লেশমাত্র নেই। এও একধরনের শিক্ষা হয়তোযে সমাজ আমাদের শিখিয়েছে যে পরিচিতি পাওয়ার মধ্যেই শ্রেষ্ঠ সাফল্য, উডও নিশ্চিত সেই সমাজেরই একজন ছিলেন। তিনিও পরিচিতি পেতে চেয়েছিলেন। পাননি। কিন্তু তাতেই কি তাঁর জীবন অসফল হয়ে গেল?” লেখক এই যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা কি প্রত্যেক সাফল্য-পেতে-চাওয়া অথচ না-পাওয়া মানুষেরই গল্প নয়? প্রশ্ন রইলো।


(৩)

“রাতে পড়বেন না” – প্রচেত গুপ্ত’র একটি গল্প সংকলনের নাম। সেটির সমালোচনা লিখেছেন সায়ন্তন মাইতি। সায়ন্তন মাইতি বর্তমান সময়ের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। কাজেই তাঁর সমালোচনায় যে বুদ্ধিমত্তার ছাপ থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। “তবু রাতেই পড়লাম। সবকটা গল্পই রাতে পড়লাম। দিনে সময় থাকলেও অন্য বই পড়ে নিতাম। কিন্তু এই বইটা খুলতাম না। প্রচেত গুপ্তও জানতেন বইয়ের নাম রাতে পড়বেন নাদেখে সবাই রাতেই পড়বে। সেজন্যই বোধ হয় গল্প সংকলনটার নাম দিয়েছেন শেষ গল্পটার নামে। আর মলাটখানাও এমন যে কেনার সাথে সাথেই গা-ছমছমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে দেবে” লেখকের সহজাত রসবুদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় শুরু থেকেই। তারপর পরতে পরতে বিশ্লেষণ ও আত্মপোলব্ধির মাধ্যমে বইটি পাঠের আকর্ষণ ও উৎসাহ অনেকাংশেই বাড়িয়ে দিয়েছেন সায়ন্তন মাইতি। আর এখানেই তাঁর কলম সফল।


(৪)

কোনো কোনো লেখার সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কবিতার মর্মস্পর্শী বিশ্লেষণ তখনই সার্থক, যখন তা আত্মা দিয়ে অনুভব করা যায়। আর সেই কাজটিতে মিলন চট্টোপাধ্যায়ের মত পারদর্শী কমই আছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি প্রবাদপ্রতিম কবিতা “যখন বৃষ্টি নামলো”এর প্রসঙ্গে মিলন চট্টোপাধ্যায় বলছেন – “কবি যেন সেই মানুষ যিনি দাঁড়িয়ে আছেন আগুনের ঘেরাটোপে! অপেক্ষা করছেন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে কখন নামবে বৃষ্টি যখনই সেই বৃষ্টি নেমে আসছে কবি ছুটছেন কাউকে দেখতে চেয়ে কোথায় সেই প্রার্থিত মানুষ ? মেঘে  বৃষ্টিতে মিশে কেন শিউলিগাছের তলায় সে আসতে পারে! শিউলি গুল্ম, বৃক্ষ নয় ফুল আরও আছে তবু শিউলিই কেন! নাকি মগ্ন চৈতন্যর রঙে মিশে যায় শিউলির সাদা আর কমলা? এই ভিজে যাওয়া আসলে শুদ্ধতার প্রতীক, শিউলি ফুলের মত সাদা কবি শুদ্ধ করছেন অন্তরাত্মাকে আকাশ ছেঁচা জলে।” এমন অপূর্ব পবিত্রতার সামনে নতজানু হতে হতে লেখকের সঙ্গে আমিও বলে উঠি সেই পঙক্তি – “ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে”।


আর এক হয়ে যাই সৌহার্দ্যের পরমতম বন্ধনে...


(৫)

অনির্বাণ ভট্টাচার্য আলোচনা করেছেন কলকাতা বইমেলা ২০১৫’য় ভাষাবন্ধন কর্তৃক প্রকাশিত ‘কথাবার্তা সংগ্রহ – নবারুণ ভট্টাচার্য’ বইটির। সদ্যপ্রয়াত কবি ও লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর অমর সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠককে আপ্লুত করেছেন বারবার। প্রয়াণের পর তাঁর যাবতীয় লেখা ও সাক্ষাৎকার’কে একত্রিত করার উদ্দেশ্যেই এই বইটির প্রকাশ। আলোচক অনির্বাণ ভট্টাচার্য সাবলীল দৃষ্টিতে নিজস্ব অনুভূতি ও পাঠ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, যা সততার জোরে নিখুঁত হওয়ার দিকে এগিয়ে গেছে অনেকটাই।


(৬)

জাফর পানাহি ইরানের একজন প্রসিদ্ধ পরিচালক। তাঁর সিনেমা ‘ক্লোজড্‌ কার্টেন’ নিয়ে আলোচনা করেছেন অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়। জাফর পানাহির সিনেমা তাঁর দেশের সরকার কর্তৃক ক্রমাগত নিষিদ্ধ হতে থাকায় এই সিনেমায় তিনি নিজেকেই নিষিদ্ধতার একটি অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কাহিনীটি অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের বর্ণনায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে এবং আকর্ষণীয়ও বটে।


(৭)

বুদ্ধদেব গুহ বাংলা সাহিত্যের এক স্মরণীয় নাম। তাঁর উপন্যাস আপামর পাঠককে মুগ্ধ ও আচ্ছন্ন করেছে বছরের পর বছর। প্রকৃতিচেতনা ও সম্পর্কের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম টানাপোড়েনের জটিলতায় তাঁর দখল সত্যিই প্রশ্নাতীত। কালজয়ী বেশ কিছু উপন্যাস, যেমন – ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘কোজাগর’, ‘কোয়েলের কাছে’, ‘বাবলি’ ইত্যাদিতে প্রকৃতি ও প্রেম আবির্ভূত হয়েছে উপন্যাসের পটভূমিকায়।

দীপঙ্কর বেরা এখানে আলোচনা করেছেন বুদ্ধদেব গুহ’র ‘পর্ণমোচী’ উপন্যাস সম্পর্কে। কিন্তু সীমাবদ্ধতা ও একটি উপন্যাসের সমালোচনার জন্য যথেষ্ট যত্ন না নেওয়ায় সামগ্রিকভাবে আলোচনাটি কিঞ্চিৎ দায়সারাই লেগেছে। অন্তত আরো যত্নে ও বিস্তৃতি সহকারে লেখা যেতো উপন্যাসটির সারবস্তু ও পাঠ-অনুভূতি।


(৮)

‘সুরজিৎ ও বন্ধুরা’ ব্যান্ডের কিছু গান নিয়ে আলোচনা করেছেন জয়তী অধিকারী। গান যেহেতু শ্রুতি’র মাধ্যম, তাই শোনার পর কথা ও  সুর সহযোগে পরিপূর্ণতার রেশ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আলোচনাকারী। রিভিউ হিসেবে সেটি সার্থক। কিন্তু আমি নিজে ওই গানগুলি না শোনায় ও সুরের মাধুর্যে বুঁদ হওয়ার সুযোগ এখনও না আসায়, অনুভূতিগুলি’কে জয়তী অধিকারী’র একান্ত নিজস্ব হিসেবেই স্বীকৃতি দিলাম, একাত্ম হলাম না, একতরফা কথার তরীতে ভর করে...

 

(৯)

সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি লিখেছেন ক্রিকেট সম্পর্কে রিভিউ। সেই বিতর্কিত ভারত-বাংলাদেশ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ নিয়ে। যেটি ইতিমধ্যেই বহু আলোচিত এবং দুই দেশের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটেছিল ওই ম্যাচটি কেন্দ্র করে। ক্রিকেটের রিভিউ বলতে আমরা সংবাদপত্রের আর্টিকেল পড়েই অভ্যস্ত। সেখানে এই লেখাটি যেন মাধ্যমিকের “তোমার দেখা একটি খেলার অভিজ্ঞতা” জাতীয় প্রবন্ধ রচনার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবন্ধ হিসেবে যতখানি সার্থক, রিভিউ হিসেবে কিনা, প্রশ্ন রইলো।


(১০)

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত লিখেছেন “আরো অনেক অল্প কথায় গপ্পো” নামক অণুগল্পের সংকলনটি নিয়ে। যেটি কলকাতা বইমেলা ২০১৫’য় প্রকাশিত, ‘পত্রভারতী’ থেকে, ‘সুরজিৎ ও বন্ধুরা’ কর্তৃক। আলোচক বলছেন – “যারা সাহিত্যে ঘুমোন, সাহিত্যে শ্বাস নেন তাদের মনে হতে পারে একটি সাধারণ প্রয়াস।  কিন্তু এই প্রয়াসটিতে একগুচ্ছ মানুষ আছেন যারা লেখালেখি করেন আর একসাথে হয়ে আরও নতুন কলমচিদের লিখবার জায়গা করে দিয়েছেন। এটা ইংরেজি মিডিয়ামের জ্বরগ্রস্ত নাগরিক সমাজের পক্ষে জলপট্টি। জ্বর ছাড়বে কিনা জানা নেই... তবুও চেষ্টা”উদ্যম হিসেবে সত্যি প্রশংসনীয়। একই সাথে যদি পছন্দের অণুগল্প লেখকদের লেখা নিয়েও স্বল্প পরিসরে আলোচনা করতেন আলোচক, পাঠকদের কাছে একটা দিশা পৌঁছতো সমকালীন লেখকদের সম্পর্কে। কেননা ঋদ্ধ এই সংকলনটি যে ‘ছাইচাপা সোনা’র মতো ভবিষ্যতের অনেক সফল সাহিত্যিক’কে বহন করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।


(১১)

শ্রেয়ণ রায় আলোচনা করেছেন বালিগঞ্জ স্বপ্নসূচনা’র নাটক ‘নাগমন্ডলা’ নিয়ে। না-বলে উপায় নেই, দায়সারা লেখা ও গভীরতার অভাবে আলোচনাটি কোনো উৎসাহ’ই জাগায়নি পাঠক হিসেবে আমার মনে। যেন আলোচক’কে শব্দ বেঁধে দেয়া হয়েছিল, অতিক্রম করলেই ফাঁসি।


অতএব হেড একজামিনার হিসেবে তবুও প্রয়াস’কে লেটার মার্কস না দিতে পারলেও প্রথম ডিভিশানে পাশ করেছে অবশ্যই। বাকিটা পাঠক’দের জন্য থাক...



২৫ এপ্রিল ২০১৫

ভিসুয়াল ইন্টারপিটেশন - মৃগাঙ্ক শেখর গাঙ্গুলী

ভিসুয়াল ইন্টারপিটেশন - মৃগাঙ্ক শেখর গাঙ্গুলী

সিনেমা রিভিউ১-সোহম চক্রবর্তী

সিনেমাএডউড
পরিচালক – টিম বার্টন
ভাষা – ইংলিশ 


এডওয়ার্ড ডি. উড জুনিয়র। সংক্ষেপে এড উড। পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট পরিচালক। এরকম খেতাবপ্রাপ্ত একজনের জীবনের ওপর সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন বর্তমান কালের হলিউডের এক অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাতা টিম বার্টন। এড উডের নাম কেউ শুনে না থাকলেও টিম বার্টনের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। বিখ্যাত মাইকেল কিটন অভিনিত ব্যাটম্যানসিরিজের (১৯৮৯-৯০) পরিচালক ছাড়াও টিম বার্টনের ঝুলিতে আছে আরো অনেক সাড়া জাগানো ছবি। যেমন Edward Scissorhand, Charlie and the Chocolate Factory, Planet of the Apes, Sweeny Todd, ইত্যাদি। এরকম স্বনামধন্য নির্দেশক হঠাৎ পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট পরিচালকের খেতাবপ্রাপ্ত একজনের জীবন নিয়ে সিনেমা কেন করতে গেলেন? কী উদ্দেশ্য ছিল তার? শুধুই কী একটা হাইপের সম্ভাবনা মাথায় রেখে? মনে হয় না।


 টিম বার্টনের সিনেমা ক্যাটালগে নজর রাখলে দেখতে পাবেন তাঁর সিনেমাগুলি ঠিক সাধারণ হলিউডি সিনেমার মতো নয়। প্রত্যেকটা সিনেমাতেই গল্পটা realism থেকে সরে magic reality-এর একটা জায়গায় এসে পৌঁছয়। টিম বার্টনের যারা ফ্যান তারা ঠিক এই কারণটার জন্যেই ওনার ফ্যান। টিম বার্টন হয়তো এড উডের সিনেমার মধ্যেও অতিপ্রাকৃতের প্রতি ওনার আকর্ষণটা উপলব্ধি করেন। বস্তুত, এড উডের যে কিঞ্চিৎ পরিমাণ সিনেমা জনসাধারণের সম্মুখে (পড়ুন বক্স-অফিসে) এসেছিল, সেগুলি সবই সেই ঘরানার সিনেমা। যারা আমরা সিনেমা দেখি বা ভালোবাসি, তারা জানি যে এই ঘরানার সিনেমা খারাপ তৈরী হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে বেশী। টিম বার্টনের মতো এই ঘরানায় প্রসিদ্ধ একজন চলচ্চিত্রকারের হাত দিয়েও বেরিয়েছে Mars Attacks! বা Dark Shadows-এর মতো নিম্ন জাতের ছবি। টিম বার্টন ভালো করেই জানেন যে পথে তিনি হাঁটেন তা কতটা পিচ্ছিল, এবং সেই পিচ্ছিলতায় পা ফসকে আলুর দম হয়ে যাওয়া কতটা সহজ। তাই হয়তো তাকে টেনেছিল এমন একজনের জীবনী যে এই পা ফসকে সবথেকে মুখরোচক আলুর দমটি হয়েছেন। সাইকোলজিক্যালি হয়তো একটা চরম ভীতিও কাজ করে থাকতে পারে স্বনামধন্যতার বিপরীতে অবস্থিত মেরুটার প্রতি। তাই সেখানে বিরাজমান ব্যক্তিটির জীবনে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন টিম বার্টন। বস্তুত, এটি টিম বার্টনের প্রথম দিকের সিনেমা। তাই এই ভীতি তখন ওনার মধ্যে কার্যকর থাকার সম্ভাবনা প্রভূত কিন্তু সেই বিপরীত মেরুতে অবস্থিত প্রাণীটির জীবন কি সত্যিই বড় করুণাময় ছিল। এড উড যা অর্জন করতে পারেননি তা নিজস্ব নির্গুণতার কারণেই পারেননি। তার সিনেমায় কন্টিন্যুয়িটির কোনও মা-বাপ থাকত না। ভয়ংকর দুর্বল সেট ডিজাইন। তার নিজস্ব ‘ম্যাগনাম ওপাস’ Plan 9 From Outer Space সিনেমায় কাগজের প্লেট সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে সেটাকে ফ্লাইং সসার বলে দেখানো। এড উড সিনেমাটা দেখে যতদূর মনে হল উনি জীবনে কখনও কোনও রিটেক করেননি। এই হতশ্রী নির্দেশনার কারণে তার লব্ধ খেতাবটা হয়ত সত্যিই প্রাপ্ত। কিন্তু তাই বলে তিনি জীবনে যে একটি সর্বনিকৃষ্ট মানুষ ছিলেন তা মোটেই না। বরং তার মধ্যে ছিল প্রকৃত বন্ধুত্বের সর্বপ্রকার গুণাবলি। বেলা লুগোসি বলে হাঙ্গারিয়ান অভিনেতা (ইনি ১৯৩১ ড্রাকুলা খ্যাত) তার অন্তিমকালে যখন ডুবন্ত সূর্যের গ্লানিতে জর্জরিত, তখন ঘটনাচক্রেই আলাপ হয়ে যায় তার এড উডের সঙ্গে। এড উড ওনাকে অবশ্যই তাঁর সিনেমার অর্থসংগ্রহের টোপ হিসেবে ব্যবহার করত (যদিও সেই সময় লুগোসি অভিনয় করছেন দেখিয়ে টাকা সংগ্রহ করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল)। কিন্তু ওনার শেষ বয়সের একমাত্র সঙ্গীও ছিলেন তিনি। লুগোসির মরফিনের নেশার সেই শেষ দিনগুলোতে উড ছিলেন তার একমাত্র বন্ধু। উড চেষ্টাও চালিয়ে গেছেন লুগোসিকে অভিনয়ের জগতে ফিরিয়ে আনার জন্য।


 এছাড়াও উডের পার্সোনাল লাইফ ছিল একেবারেই আলাদা। যে বৈশিষ্ট্যটি নজর কাড়ে সেটা হল ওনার Transvestism,  অর্থাৎ উনি মহিলাদের পোষাক পরতে পছন্দ করতেন। টিম বার্টনের ছবিতে আমরা এও দেখতে পাই যে উনি যখন stressed অনুভব করতেন তখন উনি মহিলাদের পোষাক পরে নিজের anxiety দূর করতেন। কখনও কখনও উনি সেই পোষাকেই পরিচালনা করতেন। কিন্তু তিনি বরাবরই নারীদের প্রতিই আসক্ত ছিলেন এবং তাঁর গার্লফ্রেণ্ডকে যথেষ্ট ভালোও বাসতেন। ওনার প্রথম সিনেমা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে (১৯৫৩) ‘Glen or Glenda’ তার নিজস্ব এই transvestism-এর উপরেই। বলাই বাহুল্য, সেই সময়ে হলিউডে এই বিষয় নিয়ে সিনেমা বানানো ভাবনার বাইরে ছিল যে কোনও নির্দেশকের। উড যদি নিকৃষ্টতম ডিরেক্টর না হতেন তাহলে হয়তো আমরা ওনাকে এখন এই বিষয়ে বানানো প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে মনে রাখতাম (সর্বপ্রথম কিনা সঠিক আমার জানা নেই)। এই মহিলাদের পোষাক পরাকে কেন্দ্র করে ওনার প্রথম গার্লফ্রেণ্ডের সাথে ওনার বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু পরবর্তী গার্লফ্রেণ্ড এই বিষয়টাকে মেনে নেয় এবং তাঁরা দু’জন বিয়েও করেন।


 উডের জীবনকে দেখার চোখ ছিল একেবারেই আলাদা। অনেকটা বালকের মতো, সবকিছুতেই একটা স্বাভাবিক বিস্ময় ভরা। এ ছাড়া তিনি ছিলেন চূড়ান্ত আশাবাদী। চতুর্দিক থেকে ওনার ছবি, গল্প, চিত্রনাট্য নিন্দিত হওয়ার পরেও উনি বিচলিত হতেন না। সর্বদা মনে করতেন যে পরবর্তী সিনেমা হিট করবে এবং তিনি বন্দিত হবেন ওনার মানসগুরু অরসন ওয়েলেসের মতো। নিজেকেও ওনার মতো চিত্রনাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা হিসেবে দেখতেন উড। এই আশাবাদীতার কারণে বাস্তব থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতেন উড। তবুও খারাপ ছবি করার নিশ্চয়তার মতোই ওনার আশেপাশে একটা নিশ্চিত বন্ধুদের দল সবসময় ছিল। ছবির টাকা জোগাড়ের জন্য উড নিজের আত্মসম্মানের তোয়াক্কা করতেন না। বস্তুত, তাঁর আত্মসম্মান জ্ঞান ছিল অপ্রতুল। তাঁর কাছে সিনেমা বানানোটাই মোক্ষ ছিল, যেন তেন প্রকারেণ। সেদিক দিয়ে দেখতে হলে সিনেমার প্রতি একনিষ্ঠাবান ছিলেন তিনি। কিন্তু চলচ্চিত্রের যে শিল্পকলা তা শেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি কোনদিনই। করলে হয়তো তাঁকে নিয়ে এই সিনেমাটা কোনদিনই বানাতেন না কেউ। তিনিও মাঝারি মাপের অচেনা অজানা কোনও নির্দেশক হিসেবে রয়ে যেতেন।
 উড স্টক ফুটেজ প্রভূত পরিমাণে ব্যবহার করতেন তার সিনেমায়। টিম বার্টনের সিনেমা দেখে যা বোঝা যায় তা হল উডের ট্যালেণ্ট ছিল অন্য জায়গায়। সেটা হল প্রোডাকশনে।  উনি জোগাড় করতে ওস্তাদ ছিলেন। তাই বারবার আটকে পড়া সত্ত্বেও উনি সিনেমা বানাতে সক্ষম হয়েছেন। সেটি ওনার প্রযোজনার জোরেই। যদি উনি আরো উপরতলার লোকজনদের চিনতেন তাহলে হয়ত তার সেট আরো ভালো হতো। কিন্তু তাকে স্টুডিও থেকে প্রপ চুরি করে ব্যবহার করতে হত। কারণ বাজেট সবসময় সীমিত থাকত। উঠতি নির্দেশকেরা এই সিনেমাটা থেকে অনেককিছুই রিলেট করতে পারবে এই সূত্রে। কীভাবে কম বাজেটের মধ্যে সিনেমা করা, স্টক ফুটেজ দিয়ে সিনেমা বানানো, টাকা জোগাড় করার প্রচেষ্টা, এই সবকিছুই যে কোন উঠতি অনামী চলচ্চিত্রকারের জীবনের অংশ। রিভিউয়ের শেষে বলতেই হয় যে টিম বার্টন একটি অনবদ্য কাজ করেছেন। সিনেমা শৈলীর মধ্যে আমরা পরবর্তী পরিপক্ক টিম বার্টনের ছায়া ভালোভাবেই দেখতে পাই। ওনার সেন্স অফ হিউমার অনন্য। সেই হিউমার এই ছবিতেও বর্তমান। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে ছবি বানানো, যদিও তার সহযোগীতায় ছবিকে নিরানন্দ ম্লান লুক দেওয়ার কোনও অপপ্রচেষ্টা করেননি বার্টন। ছবিটা কখনই কোনও দুঃখের সন্ধান করে না, শুধুমাত্র লুগোসির জীবনে ছাড়া। উডের যতটুকু জীবন দেখানো হয়েছে তাতে দুঃখের লেষমাত্র নেই। এও একধরনের শিক্ষা হয়ত। যে সমাজ আমাদের শিখিয়েছে যে পরিচিতি পাওয়ার মধ্যেই শ্রেষ্ঠ সাফল্য, উডও নিশ্চিত সেই সমাজেরই একজন ছিলেন। তিনিও পরিচিতি পেতে চেয়েছিলেন। পাননি। কিন্তু তাতেই কি তাঁর জীবন অসফল হয়ে গেল। টিম বার্টন সরাসরি না হলেও এই প্রশ্নটা করে দিয়ে গেছেন তাঁর এই ছবিতে। উডের জীবন আমরা কিন্তু হাসিখুশি হিসেবেই দেখি। কোথাও কখনও দুঃখের ছায়া পাই না। টাকা জোগাড় না হওয়ার টেনশনের মধ্যেও না। এরকম ভাবে বেঁচে থাকতে পারার মধ্যে কি কোনও সাফল্য নেই? এভাবে বেঁচে থাকতে পারাটাই কি সাফল্যের চূড়ান্ত মাপকাঠি হতে পারে না? এই প্রশ্নগুলোই এসে ভিড় বসায় সিনেমাটা শেষ হওয়ার পর। আর কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মুখে একটা সুন্দর হাসি এসে যায়।

গল্প সংকলন রিভিউ- সায়ন্তন মাইতি

প্রসঙ্গঃ ‘রাতে পড়বেন না’ (প্রচেত গুপ্ত)

তবু রাতেই পড়লাম। সবকটা গল্পই রাতে পড়লাম। দিনে সময় থাকলেও অন্য বই পড়ে নিতাম। কিন্তু এই বইটা খুলতাম না। প্রচেত গুপ্তও জানতেন বইয়ের নাম ‘রাতে পড়বেন না’ দেখে সবাই রাতেই পড়বে। সেজন্যই বোধ হয় গল্প সংকলনটার নাম দিয়েছেন শেষ গল্পটার নামে। আর মলাটখানাও এমন যে কেনার সাথে সাথেই গা-ছমছমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে দেবে। আমি তো বইটা ব্যাগে পুরে মিত্র ও ঘোষের স্টল থেকে বেরিয়ে ভেবেছিলাম, আস্ত একটা ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছি ব্যাগে। বাড়ি এসে ধারণা বদ্ধমূল হল, যখন দেখলাম ভূমিকাতেও প্রচেতবাবু ভূতের গল্প লেখার অভিজ্ঞতার কথাই বলেছেন।


কিন্তু গল্পগুলো পড়তে গিয়ে সেই পাগলা দাশুর বাক্স খোলার মত অবস্থা। আরে, ভূত কই???? ‘দেশ’ রেগুলার রাখার সুবাদে ‘ফিসিফিস’, ‘পরদা’ তো আগেই পড়েছি, এখন দেখছি বাকি গল্পগুলোও কম-বেশি সেরকমই। প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটি নিয়ে শুরু হচ্ছে, কিন্তু গিয়ে শেষ হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক উপসংহারে। হ্যাঁ, ভূত যে একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু ‘গঙ্গা কোথায়’ ছাড়া প্রত্যেকটা ভূতের গল্পই প্রশ্নচিহ্ন রেখে দেয়, আসলে ভূত না হ্যালুসিনেশন? ...আর তখনই বইয়ের নাম এরকম রাখার যথার্থ কারণ পাওয়া যায়। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক কাহিনী পড়া এবং তার বিশ্লেষণ করা দুটোর জন্যই আমাদের মাথা ভালো খোলে। মনোবিশ্লেষকদের সেরকমই ধারণা। সুতরাং, যাকে আমরা ভৌতিক পড়ে থ্রিল অনুভব করার উৎস বলে ভেবেছি, সেটা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অলিগলিতে নিপুণভাবে আঁচড় কেটে যাবে। এবং হ্যাঁ, তার সাথে থ্রিলও রয়েছে, রয়েছে কমেডির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কাজ। রয়েছে রূপক, কোথাও কোথাও দুর্দান্ত স্যাটায়ার। সবমিলিয়ে দিনে পড়ার চেয়ে রাতেই পড়ার বই। আর এত কিছুর কোলাজ বলেই বলছি, এই বই হাতে পেলে গোগ্রাসে গিলে খাওয়া যায় না, চিবিয়ে চিবিয়ে হজম করতে হয় 

আমার জানা নেই ছোট ছোট গল্পের মধ্যে দিয়ে মনস্তত্ত্বের এত সূচারু বিশ্লেষণ এর আগে কেউ করেছেন কিনা। প্রচেত গুপ্ত এমন সব না জানা জায়গায় আলো ফেলেছেন, যার কথা বাইরের অনেক দেশে বহুল পরিচিত হলেও আমাদের এখানে অনেক ‘বিদ্বজ্জন’ও জানেন না। যেমন ধরলাম, প্রথম গল্পেই (‘অনুসরণকারী’) স্প্লিট পার্সোনালিটি। রোগটা কিন্তু খুব কমন। তবু আমাদের এখানে অনেকে জানে না। সমাজের এই না-জানার ফল সুদুরপ্রসারী। এতে এই রোগের রুগীদেরও আরোগ্যলাভের রাস্তায় ছেদ পড়ে যায়। নিজেকে দ্বৈত সত্তায় বিভাজিত অবস্থায় দেখছেন, এমন মানুষ কিছু চারদিকে হামেশাই আছেন। সবার অবস্থা বা আনুপূর্বিক ঘটনা গল্পের ‘খোচর’এর মত নয়, কিন্তু অনেকের মধ্যেই এটা আছে। অথচ এমন মানুষের সন্ধান পেলে সবাই পাগল ঠাওরাবে। কিংবা ‘লোকটা’ গল্পের স্বামীসর্বস্ব গৃহবধুর মত ‘ক্যাপগ্রাস ডিলিউশন’ হতে দেখলেও তা-ই বলবে। এই রোগ অপেক্ষাকৃত কম হলেও কিছু মানুষের মধ্যে আছে। আসলে, মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান এতই কম যে, যে কোনো সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার দেখলেই আমরা সংক্ষেপে উপসংহার সারি, “মালটা পাগল”। সেদিক থেকে, ‘রাতে পড়বেন না’ গল্পগ্রন্থকে সচেতনতামূলক বইও বলা যায়। প্রচেত গুপ্তর প্রাঞ্জল ভাষা, অসাধারণ ঘটনাবিন্যাস নিয়ে আমার পক্ষে কিচ্ছু বলা সম্ভব না। পাঠক আঠার মত বইয়ের সাথে সেঁটে থাকতে বাধ্য। আমি শুধুমাত্র গল্পের অন্তরীণ অর্থ আর গল্পের ভিতর সমাজ প্রতিফলন নিয়ে সামান্য দু-চার কথা বলব।


সাইকোলজিক্যাল কথাতেই থাকি। প্রচেত গুপ্ত অনেক গল্পেই কমবেশি প্রশ্ন রেখে দিয়েছেন, আসলে কী হল? গল্পকে যে নানা দিক থেকে ব্যখ্যা করা যায়, সে তো স্পষ্টই। এখন প্রশ্ন হল, নানাদিকের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দিক কতটা? খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যাবে, প্রত্যেক গল্পেই কমবেশি। ‘ফিসফিস’এর আপাত অর্থ অডিও হ্যালুসিনেশন হলেও ভেতরে রয়েছে একজন ভীতু, মেরুদণ্ডহীন মানুষের ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। ‘পশুপতির দুই বঊ’ আপাতভাবে ভৌতিক গল্প হলেও পরোক্ষে যেন মনে হয়, প্রত্যেকটা মানুষের অবচেতনের ভয় বাইরের সাহসী সত্তাকে ব্যঙ্গ করে চলে গেল। শেষ দৃশ্যটা ভেবে দেখুন, ‘সাহসী’ বউয়ের ভয় পাওয়ার কথা কেউ জানতেও পারল না, জানল শুধু ‘ভীতু’ বউটার আত্মা। ‘পরদা’তে সমান্তরালভাবে এগিয়েছে দুটো মনস্তত্ত্ব। একজন মহিলার বারবার মা হতে গিয়ে সন্তানহারা হওয়ার যন্ত্রণা আর অনেকদিন সঙ্গম থেকে তাঁর শরীর বঞ্চিত থাকার হতাশা, সেই সাথে একজন পুরুষের ফিয়ার কমপ্লেক্স - এই গল্প না পড়লে বোঝাই যেত না সবগুলোকে এক জায়গায় আনা যায়। তবে রূপকের ব্যবহার সবথেকে বেশি করেছেন ‘গোলমেলে গল্প’তে। তিনটে আলাদা সময়ে ফোনের ব্যবহারের অন্তরালে মানুষের জীবনে তিন স্টেজে প্রেমের আলাদা আলাদা অভিব্যক্তি কৌশলে লেখক ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যে অংশটা সময়ের থেকে লেখক এগিয়ে নিয়ে গেছেন, সেটা আসলে অনেকদিন ধরে দাম্পত্য জীবন কাটানোর পর। যে অংশটা লেখক এই সময়ের প্রেক্ষিতে এনে ফেলেছেন, সেটা সবে চাকরি পাওয়া ছেলেমেয়েদের অনভ্যস্ত কর্মব্যস্ততার মাঝে প্রেমের অবসর। আর যে অংশটা অনেক আগে হয়ে গেছে, সেটা স্কুলজীবনের সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ। কী, এমনটা ভাবলেই প্রত্যেকটা কথা খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে না?


কোনো সংকলন-গ্রন্থ আলোচনাতেই আমি চিরাচতির প্রথা মেনে চ্যাপ্টার ধরে ধরে এগোই না। এক্ষেত্রেও সেটাই করছি। তাছাড়া প্রচেত গুপ্তর বহুমাত্রিক গল্পগুলো তো আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রার আনাচে কানাচে ছড়ানো। ‘ফুলের তোড়া’ই হোক আর ‘আধেক দুয়ার খোলা’, অত্যন্ত সাধারণ মানুষদের ভীষণ পরিচিত এক একটা ঘটনার ভিতর থেকেই প্রচেত গুপ্ত গল্পের প্লট তৈরী করেছেন। আদ্যোপান্ত কমেডির গল্প ‘পেরেক’এর ফাঁকে ফাঁকেও রাজ্যের অফিস-কাছারির বাস্তব চিত্র, শান্ত নির্বিবাদী বাবার উপর ছেলে-মেয়ের মেজাজ – সবকিছু সুন্দরভাবে গুঁজে দেওয়া। দৈনন্দিন চালচিত্রের এমন এক একটা অংশকে রম্যরচনার ছাঁচে ফেলেছেন, যা আমরা রোজ দেখি বা করে থাকি কিন্তু তার থেকে যে এমন কিছু বানানো যেতে পারে তেমনটা আমাদের ধারণার বাইরে। শুধু রম্যরচনাই নয়, ‘হানিমুন’ গল্পে সামাজিক বিয়ের বর্বরতাকে চরমভাবে লেখক ব্যঙ্গ করেছেন। গল্পের শেষে উত্তরবঙ্গের ভূতুড়ে অভিজ্ঞতাটা গল্পকে আতিপ্রাকৃতর দিকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু শেষ লাইন অবধি লেখক সেই ব্যঞ্জনাটাই দিয়ে গেছে, যাকে একজন চেনে না জানে না তাকে শুধুমাত্র মোটা খামের চাকরির কারণে বিয়ে করে ফেলা – ভবিষ্যতে অনেক সর্বনাশের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সমাজ ও মনস্তত্ত্বের অসাধারণ মিশেল তৈরী হয়েছে ‘পাশে আছি’ গল্পে। লেখক দেখিয়েছেন, শোরগোল তোলা প্রতিবাদগুলো বাস্তবিক অন্তঃসারশূন্যই হয় আবার, শহরে চিকিৎসা করাতে এসে অনভিজ্ঞ গ্রামের মানুষদের চরম ভোগান্তি – সব যুগেই ছিল, এখনো আছে। অথচ তাই নিয়ে কারোর উচ্চবাচ্য নেই। ‘চিরুনি’ গল্পেও সমাজ প্রত্যায়িত ‘অপরাধ’ আর অবচেতনের ‘অপরাধ’ দুটো দিকই দুর্দান্তভাবে লেখক তুলে ধরেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক হোক কি সমাজের ‘এলিট’ ক্লাসের মানুষ হোক, ‘মনস্তত্ত্ব’ বিষয়টা সম্বন্ধে ধারণা খুব কম মানুষেরই আছে। আর সমাজবিজ্ঞান সম্বন্ধে যা ধারণা আছে, বেশিরভাগই মনগড়া। এ দুটো একটু সূচারুভাবে থাকলে হয়তো প্রচেতবাবু যে সমস্যাগুলো দেখিয়েছেন, সেগুলোকে আলাদা করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কোনো দরকার হত না।


আর একটা ব্যাপারেও প্রচেতবাবু নতুনত্বের ছাপ রেখেছেন। গল্পের মোড় পরিবর্তন। ‘মশারি’ গল্পটা যেমনভাবে কমেডি দিয়ে শুরু হল, কেউ ভাবতেও পারবে না যে, শেষে গিয়ে ভৌতিক চেহারা নেবে। আর সেটাও হঠাৎ করে। এর ঠিক বিপরীতটা দেখা যায় ‘একটা দিন’ গল্পে। সাসপেন্সের শিরশিরানি পরিণত হল মিষ্টি নস্ট্যালজিয়ায়। একটা সুখস্মৃতি কে ফিরিয়ে দেবে, কীভাবে ফিরিয়ে দেবে, আদৌ সে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিনা সব ধোঁয়াশাই থেকে গেল। অথচ গল্প শেষ হল চমৎকার এক পশলা আনন্দ দিয়ে। থ্রিলার মানেই আদ্যোপান্ত থ্রিলার, তাতে বিদেহী আত্মার প্রবেশ ঘটলে প্রথম থেকেই অতিপ্রাকৃত ঘটনাক্রম – এরকম একপেশে গল্পের ধারণা অনেক দেশেই পাল্টে গেছে। স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানিতে নব্বই দশক থেকে এরকম সিনেমাও অনেক বেরিয়েছে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ঘরানাভিত্তিক গল্পের আবরণ ছেড়ে এরকম মোড় ঘোরানোর ধারা কিন্তু তেমন চোখে পড়ে নি। থাকলেও জনপ্রিয় গল্পে অন্তত নেই। সেদিক থেকে প্রচেত গুপ্ত নতুন পরীক্ষা করেছেন বলা যায়। গল্পের চরিত্রের মধ্যেও এমন পরিবর্তন এনেছেন। এগুলোকে ঠিক ‘পরিবর্তন’ বলা যায় না, বরং এই বার্তাটাই লেখক বোধ হয় দিতে চেয়েছেন যে, প্রত্যেকটা মানুষের যে চেহারাটা দৃষ্টিগোচর হয়, তার আড়ালে অন্য মানসিকতা থাকে। অনেক সময় অন্য ক্ষমতাও থাকে। সময়মত তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ‘চিরুনি’, ‘ফিসফিস’, ‘চৌর্যশৌর্য’ প্রত্যেকটা গল্পের মধ্যেই এমন চরিত্র পাবেন।


শুধু একটা প্রশ্ন থেকে গেল। প্রশ্ন ঠিক বলা যায় না, সামান্য একটা কৌতূহল। ‘চিরুনি’ হোক, কি ‘লোকটা’, প্রচেত গুপ্ত সমস্যাগুলো দেখিয়েছেন সাইকোলজিক্যাল, কিন্তু তার নিস্তারের জন্য গল্পের চরিত্রদের পাঠিয়েছেন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। ‘পরদা’তেও দেখা যাচ্ছে একজন সঙ্গম অনিচ্ছুককে তাঁর স্ত্রী ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিচ্ছে, মনোবিদ নয়। ....এখন একটা ব্যাপার পরিষ্কার করি, যা রোগ নয়, কথার মলমে যার ঘা সারে, সেগুলোর জন্য সাইকিয়াট্রিস্টের থেকেও সাইকোলজিস্টরাই বেশি সিদ্ধহস্ত ও কার্যকরী। দুই পেশার মধ্যে তফাত খুব সামান্যই। কিন্তু বর্তমানে যেটা হচ্ছে, ‘কাউন্সেলিং’এর জন্য, বিশেষ করে দীর্ঘ সময়ব্যাপী কাউন্সেলিং-এর জন্য সাইকিয়াট্রিস্টরা আর সময় দিচ্ছেন না, রোগীকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সাইকোলজিস্টের কাছে। যন্ত্রনির্ভর লাইফস্টাইলে আর প্রতিযোগিতার যুগে নিউরোলজিক্যাল সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় বিচিত্র ধরনের রুগী দেখে তাদের জন্য নার্ভ স্টেবিলাইজার, মেমব্রেন স্টেবিলাইজার প্রেসক্রাইব করতে করতেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ চিকিৎসকদের সময় চলে যাচ্ছে। তাই ‘কাউন্সেলিং’এর সময়টা আস্তে আস্তে তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রচেতবাবু যে সমস্যাগুলো দেখিয়েছেন, সেগুলোতে। আর এগুলোর ক্ষেত্রে মনোবিশ্লেষকরা সাধারণত ‘থট রিডিং’এর কাজটা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের চেয়ে ভালো করেন। তাই, ‘মনোবিশ্লেষক’ প্রফেশনটাকে একটু হাইলাইট করলেই কি ভালো হত না?


সবশেষে বলি, মনস্তাত্ত্বিক আখ্যান লিখতে গেলে তাতে পাঠককে শেষ পাতা অবধি বসিয়ে রাখার জন্য অনেক চিত্তাকর্ষক উপাদান রাখতে হবে – এটা সবার শেখার আছে প্রচেত গুপ্তর প্রত্যেকটা লেখা থেকে। আশা করব, এই রাস্তায় হেঁটে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে এই ধরনের লেখা আরো আসবে।


(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ছয় নম্বর অনুচ্ছেদের শেষটা পড়ে দেখুন। তারপর চলে যান চার নম্বর অনুচ্ছেদের শেষে।

বলেছিলাম না, আপাত চেহারার আড়ালে অনেক লুকোনো ক্ষমতা থাকে? ঠিক তেমনই ‘গোলমেলে গল্প’এর ‘খাপে-খাপে-মিলে-যাওয়া’ ব্যাখ্যাটা দিয়েছে আমার এক অ-লেখক ভাই, যার গল্প-উপন্যাস প্রায় পড়া নেই বললেই চলে। কোনো সাহিত্য আলোচনাও শোনে না। নাম, নীলেশ দাস। ওকে জোর করে এই বইটা ধরিয়েছিলাম, এখন প্রচেত গুপ্তর ভক্ত হয়ে গেছে। আমি প্রথমে গল্পটার অন্য একটা ব্যাখ্যা ভেবেছিলাম, কিন্তু নীলেশের ভাবনাচিন্তা শোনার পর ভেবে দেখলাম, এর থেকে ‘অবভিয়াস’ মর্মার্থ থাকা সম্ভব নয়।

তাহলে দেখলেন তো, প্রচেত গুপ্তর বানানো চরিত্ররা কিন্তু বাস্তবানুগ। এর পরে যদি দেখেন কোনো বাথরুম সিঙ্গার হেভিওয়েট খেয়াল কিংবা হার্ড রক শুনে মিনমিন করে বলছে, ‘ঠিক ভাল্লাগছে না’, তাহলে তাকে তেড়েমেড়ে ত্যারাব্যাঁকা বাক্যে বিদ্ধ করতে বসবেন না। বলবেন না, ‘তুই এসবের কী জানিস রে? আগে ডিম পেড়ে দেখা, তারপর এগ কাটলেটের নিন্দা করবি’.... আনাড়ির মতকেও সম্মান করুন। প্রচেত গুপ্ত আপনাদের এই স্বভাবকে অনেক গল্পেই কটাক্ষ করেছেন। তেমনি যেসব বাথরুম সিঙ্গার ‘আমার ভাল্লাগছে না’র সীমা ছাড়িয়ে ডিসেকশন করতে বসে, তাদেরও মোক্ষম এক হাত নিয়েছেন অনেক জায়গায়।

ভদ্রলোকের সব গল্প, উপন্যাস রাতেই পড়তে থাকুন। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে মাথা খাটিয়ে বুঝে বুঝে পড়ুন, টিপিক্যাল বাঙালী মতাদর্শকে অনেক জায়গায় ল্যাং খেতে দেখবেন। আর সেই রামচাটানি খেয়ে খেয়ে, বলা যায় না, একদিন হয়তো আমার আপনার স্বভাব বদলাতেও পারে।)

কবিতা রিভিউ- মিলন চট্টোপাধ্যায়

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা এবং আমার ভাবনা


যখন বৃষ্টি নামলো

শক্তি চট্টোপাধ্যায়

 

বুকের মধ্যে বৃষ্টি নামেনৌকা টলোমলো

কূল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনও সম্বল

নেই নিকটে – হয়তো ছিল বৃষ্টি আসার আগে

চলচ্ছক্তিহীন হয়েছিতাই কি মনে জাগে

পোড়োবাড়ির স্মৃতি আমার মধ্যে স্বপ্নে-মেশা দিনও ?

চলচ্ছক্তিহীন হয়েছিচলচ্ছক্তিহীন


বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠান পানে একা

দৌড়ে গিয়েভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা

হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে

আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে

কিন্তু তুমি নেই বাহিরে – অন্তরে মেঘ করে

ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে


 খুব কষ্ট পেলে বুকে নামে শ্রাবণ। হূহূ হাওয়া দেয়। ভিজে যাই অবিরাম। তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতা আশ্রয় হয়ে ওঠে। বৃষ্টি নামছেকোথায়নামছে বুকের মধ্যে। নৌকা টলোমলো কেনকে আছে সেই নৌকায়কেন ভারসাম্য নেইচলচ্ছক্তিহীন হয়েছেন বলেকবি স্থবির, তাকে ঘিরে ধরেছে এ কোন্‌ দহনবৃষ্টি আসে দহনের পরেই। গতিউর্বরতার প্রতীক হয়ে। জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ধূধূ উষর প্রান্তরদগ্ধ গাছ যেভাবে প্রতীক্ষা করে জলধারার কবিও তেমনই প্রতীক্ষায়। বৃষ্টি কখন আসবে;শুরু হবে বপনের উৎসব। ডমরুর মত ভেসে আসবে আওয়াজ। কবি লিখছেন -


 "কূল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনও সম্বল

নেই নিকটে – হয়তো ছিল বৃষ্টি আসার আগে..."


 এই লাইন আমাকে দাঁড় করায় এক অদ্ভুত প্রশ্নের সামনে - কূলে যেতেই তো সম্বল লাগেএ কেমন অকূল যেখানে সম্বলের কথা আসে! কেন লিখলেন কবি এই লাইনঅকুলে যেতে তো সম্বল লাগে নানাকি এ সেই মৃত্যুচেতনা যা আদিকাল থেকে পারানির কড়ি খুঁজে চলে। কবি যেতে চাইছেন কূলহীনতায় অথচ তাকে গ্রাস করছে পোড়োবাড়ির স্মৃতি। পুড়ে যাওয়া আশ্রয়কে রোমন্থন করা কেনদহনের সময় সেই বাড়িতে কে ছিলসে কি কবির প্রিয়জন নাকি কবি নিজেইনিজে হাতেই কি বহ্নিচিতায় মিশিয়েছে বাড়িএই বিষণ্ণতা বাড়ির ভেতরে থাকা কোন বাড়ির। যা আস্তে আস্তে মিশে যাবে কালের গহ্বরে


 কবি যেন সেই মানুষ যিনি দাঁড়িয়ে আছেন আগুনের ঘেরাটোপে! অপেক্ষা করছেন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে কখন নামবে বৃষ্টি। যখনই সেই বৃষ্টি নেমে আসছে কবি ছুটছেন কাউকে দেখতে চেয়ে। কোথায় সেই প্রার্থিত মানুষ মেঘে বৃষ্টিতে মিশে কেন শিউলিগাছের তলায় সে আসতে পারে! শিউলি গুল্মবৃক্ষ নয়। ফুল আরও আছে তবু শিউলিই কেন! নাকি মগ্ন চৈতন্যর রঙে মিশে যায় শিউলির সাদা আর কমলাএই ভিজে যাওয়া আসলে শুদ্ধতার প্রতীকশিউলি ফুলের মত সাদা। কবি শুদ্ধ করছেন অন্তরাত্মাকে আকাশ ছেঁচা জলে। আজানুকেশ রূপক হলেও সে বিদিশার নিশা নয়তাকে ধরা ছোঁয়া যায়। এখানেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ক্যারিজমা। শরীরহীন চৈতন্য হয় না। আর কবির পুড়ে যাওয়া আত্মার দহনপোড়োবাড়ি এই শরীর। যা শান্ত হয়ে যাচ্ছে অশ্রুপাতে। কাঁদতে না পারার যন্ত্রণাই কবিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল আগুনের ঘেরাটোপে। সে জন্যই এই লাইন -


 "কিন্তু তুমি নেই বাহিরে – অন্তরে মেঘ করে

ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে।"

 

যা বাইরে নেইঅন্তরে আছে। যা ব্যাপক বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে শুদ্ধতার দিকে

 

 

বই রিভিউ-অনির্বাণ ভট্টাচার্য

নবারুণ ভট্টাচার্য – কথাবার্তা সংগ্রহ (ভাষাবন্ধন ২০১৫) ; একটি রিভিউ



‘ওড়াটাই তো সাবভার্সিভ...’ । ভাষাবন্ধন প্রকাশিত ‘কথাবার্তা সংগ্রহ ; নবারুণ ভট্টাচার্য’ ঘাঁটতে গিয়ে মনে হল কলকাতা বইমেলা ২০১৫ স্মরণীয় হয়ে থাকলো না থেকেও ভীষণভাবে বেঁচে থাকা একমুখ দাড়িগোঁফ মানুষটার উপস্থিতি । মনে হচ্ছিল এবারেও অভ্যেসমতো কেনার পর কিছু লিখতে বলে দিই ভাষাবন্ধন স্টল আলো ক’রে বসে থাকা লেখককে । কিন্তু তা আর যখন হওয়ার নয়, অগত্যা – দেখি নবারুন-দা, (যদিও এ নামে কোনোদিন ডাকার স্পর্ধা হয়নি তাঁকে) আপনার কোন কথাগুলো এযাবৎ মিস করে গেছি আমি । সত্যিই ‘সংগ্রহ’ – কী কী নেই সঙ্কলনটিতে – বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, সেন্সরশিপ, নন্দীগ্রাম, পোস্টমডার্নিসম, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, লেখকের গদ্য-পদ্য এবং সাহিত্যজীবন, সবকিছুই এসেছে । সাক্ষাৎকারগুলির সাথে লেখকের কয়েকটি ছড়ানোছেটানো আত্মকথন জুড়ে দিয়ে রীতিমত প্রশংসার দাবি রেখেছে বইটি । কথোপকথনগুলির শিরোনাম হিসেবে নবারুণেরই কিছু চাবুক মারা কথা দিয়ে সুচীপত্র সাজানো – মনে হল নবারুণ উঁকি মারছেন – অনেকটা সিনেমায় চিঠি পড়ার মতো – পাঠকের মৃদু কণ্ঠস্বর থামিয়ে ভেতর থেকে চিঠি পড়ছে সেই চিঠির লেখক - এক্ষেত্রে বক্তা নবারুণ – ‘নিজেকে প্রান্তিক ব’লে মনে করি ...’, ‘একটা অ্যাবসার্ড পৃথিবী এসে পড়েছে’, ‘প্রত্যেককে একটা স্ট্রাটেজি ঠিক করতে হয়’ এবং আরও কত কথা । বোঝা যায় ইন্টার্ভিউ–এর ওপারে বসে প্রশ্নকর্তা টোকা মারছেন আর এপারের লোকটা একে একে খুলে দিচ্ছেন আলো-অন্ধকারের দরজাগুলো ।

নবারুণ স্পষ্টবাদী । তাই বলতে পারেন মায়ের থেকে তিনি কোনোভাবেই ইন্সপায়ার্ড নন । নবারুণ খোলামেলা । তাই শ্রীলঙ্কার ট্রটস্কাইট জেভিপি-দের উত্থানকে মুক্তকণ্ঠে সমর্থন করেন । নবারুণ সোজাসাপটা । তাই বলেন, যে শহরের দুঘণ্টা দূরে মানুষকে কুমীরে টেনে নিয়ে যায়, সেখানে ‘পোস্টমডার্নিসম হ্যানাত্যানা...’ জাস্ট বিলাসিতা মাত্র । নবারুণ ডোন্ট কেয়ার । তাই ঘোষণা করেন টেলিভিশন ‘universal corrupter... greatest prostitute’ । সবকটি সাক্ষাৎকারই মেদহীন, ঋজু, তবে আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায় (১৯৯৪) দেবেশ রায়ের সাথে লেখকের কথোপকথন, ‘অনুবাদ ও ভাষাবন্ধন’ শীর্ষক অপ্রকাশিত আলোচনাটি প্রশ্নকর্তা যেখানে রাজীব চৌধুরী ও ভাস্কর ঘোষ, ‘লিপি নাগরিক’এর ‘নবারুণের সাথে কিছুক্ষন’ এবং ঐহিক পত্রিকায় নবারুণের লেখা ‘মিথ্যে ভাঙ্গার ভাষা’ (২০১৩)। নবারুণের চৌহদ্দি ঘুরতে ঘুরতে বোঝা যায় হারবার্ট একটা ‘দার্শনিক অবজারভেশন’, ফ্যাতাড়ু ‘উইশ ফুলফিলমেন্ট’ আর ‘মৃত্যু উপত্যকা...’ বরানগর-বারাসাতে খুন হয়ে যাওয়া আট আটটা ছেলের প্রতি এক কবির কিছু করতে না পারা বিবেক । এসেছে স্ল্যাং প্রসঙ্গ । প্রান্তিক মানুষদের মুখে আর কী ভাষা বসানো যেতে পারে? প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন নবারুণ - ‘আমি নিজেই তো প্রান্তিক’ – নির্লিপ্ত উচ্চারন লেখকের । এসেছে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ । একদিকে যেমন চির-বামপন্থী নবারুণ – ‘এই আমেরিকাকে বিশ্বাস করার কোনও কারণ ঘটেনি...’ অন্যদিকে নিজের রাজ্য নিয়েও রয়েছে স্যাটায়ার ‘৩৪ বছরের বাম শাসনে শুধু পার্টিক্র্যাসিই হয়েছে...’ । খুব সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারগুলি থাকলে অবশ্য আরও কিছু যুক্ত হত (পাঠক যা বোঝার বুঝে নিন)। তবে শেষমেশ ভীষণ আশাবাদী লেখক । ‘ভালো লেখা হচ্ছে শুধু না, দাবড়ে হচ্ছে’, ‘হারবার্টরা থাকবে এবং আছে’, ‘গরীব মানুষের.....খেলা চলছে-এখনই হেরে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি’ লেখকের সাহসী ঘোষণা । এ বই নবারুন-ভক্তদের সোনার খনি । প্রতিটি লেখা আলাদা ক’রে ধরলে এবং অবশই সামগ্রিকভাবে ।


দুএকটি ক্ষেত্রে প্রশ্নচিহ্ন রয়েই গেছে যদিও । যেমন বইটির শেষে সামগ্রিকভাবে সাক্ষাৎকারগুলির কালানুক্রমিক সূচি দেওয়া আছে । অথচ প্রথমেই কালানুক্রমিক ভাবেই লেখাগুলি কেন যে সাজানো হল না – প্রশ্ন থেকে গেল । সেক্ষেত্রে পাঠকদেরই সুবিধে হতো লেখকের ক্রমিক অবস্থানটা ধরতে । ভূমিকাতেই বলা হয়েছে আরও কিছু সাক্ষাৎকার বাকী থেকে যাওয়ার কথা, যা অদূর ভবিষ্যতেই প্রকাশ পাবে । খুশীর খবর । তবে এটুকু বলা যেতে পারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কথাবার্তা সংগ্রহ’ লেখকের মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর বেরোনোয় সঙ্কলনটি সামগ্রিকভাবে একটি খণ্ডেই প্রকাশিত হয়েছিল । সেটির আকার বড় হলেও পাঠকের কাছে সুবিধাজনক হয়েছিল । এক্ষেত্রেও নবারুণের বক্তব্যগুলিকে কিছুদিন পরে একটি খণ্ডেই সঙ্কলিত করা হলে বেশ হত ।

যদিও এহ বাহ্য, এসব ছোটোখাটো জিজ্ঞাসার চিহ্ন পেরিয়ে যে রাস্তায় নবারুণের কথাবার্তা সংগ্রহের পাঠক এর মধেই এসে পড়েছেন – তা থেকে বেরনোর রাস্তা নেই । বললাম না - ‘প্রত্যেককে একটা স্ট্রাটেজি ঠিক করতে হয়’ । প্রিয় পাঠক, এবার আপনিই ঠিক করুন আপনার স্ট্রাটেজি কী হবে, একরাতেই শেষ করবেন, নাকি একটু একটু করে হেঁটে যাবেন নবারুণের সোজা কথাকে সোজা ভাবে বলার পৃথিবী-তে ।
 

সিনেমা রিভিউ- অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়

সিনেমাঃ ক্লোজ্ কার্টেন

পরিচালকঃ জাফর পানাহি

দেশঃ ইরান

সালঃ ২০১৩

         

          সিনেমার মাঝামাঝিতে পরিচালক বাড়ি ফিরে আসেন তিনি ইরান সরকারের গৃহবন্দীতাই প্রতিবেশী খাবার দিয়ে যায় রোজকাঁচ সারাইওয়ালা তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে ভয় পায় এবং তিনিবিকেলে একা জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখেন তাঁর এই অচলাবস্থায় দমবন্ধ হয়ে আসে ধীরে ধীরে হারাতে থাকে সিনেমার প্রতি উৎসাহ এবং তখনই নিজের মোবাইলে একটি ভিডিও দেখে আবার কোমর বেঁধে নেমে পড়েন সিনেমার আঙিনায় কি সেই ভিডিওদর্শকেরা এতক্ষণে জানে


          ক্লোজ্ কার্টেন’ শুরু এক বৃদ্ধকে নিয়ে ইরান সরকারের হঠাৎ জারি করা কুকুর-নিধন ফরমান থেকে বাঁচাতেপোষা কুকুরটিকে নিয়ে একটি বিচ হাউসে আশ্রয় নেয় সে কে এই বৃদ্ধইনি জাফর পানাহির স্ক্রিপ্টরাইটার ঘটনাক্রমেদিন পর রাতে দুটি ছেলেমেয়ে পুলিশের থেকে পালিয়ে জানলা ভেঙে বাড়িটিতে ঢোকে এবং শত আপত্তি সত্ত্বেও মেয়েটিকে বৃদ্ধের হেপাজতে রেখে ছেলেটি পালিয়ে যায় আর ফেরে না


          ধীরে ধীরে কুকুরটিকে কেন্দ্র করে মেয়েটির সঙ্গে বৃদ্ধের আলাপ গাঢ় হয় কিন্তু হঠাৎই মেয়েটি এক সন্ধ্যায় উধাও বৃদ্ধ অবাক সে মোবাইল ক্যামেরায় উধাও হওয়ার আগের মূহূর্তটি অভিনয় করে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছিলকিন্তু কোনো মাথা-মুন্ডু উদ্ধার করতে পারে না পরদিন সকালে আচমকা মেয়েটি ফিরে আসেকিন্তু অন্তর্ধান বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলেসে বাড়িতেই ছিল ইতিমধ্যে জাফর পানাহি ফেরেন এবং বোঝা যায় এটা তাঁর বাড়ি


          বৃদ্ধ মেয়েটিকে কোনো কিছুতে হাত দিতে মানা করেছিল তাই পানাহি যখন দেয়ালের থেকে টান মেরে মেরে সাদা কাপড়গুলো সরাতে থাকেনদেখা যায় এগুলো তাঁরই সিনেমার পোস্টার সিনেমাগুলো ইরানে নিষিদ্ধ এদিকে মেয়েটি তখন বৃদ্ধের কাছে জানতে চায়কেন সে স্ক্রিপ্ট লিখছেপানাহির তো সিনেমা বানানো নিষিদ্ধবৃদ্ধটি জানায়সে অপারগ তার কাজ শুধু লিখে যাওয়া ওমনি নিমেষে বোঝা যায় এই চরিত্রদুটি আসলে পানাহির দুই অল্টার ইগো একজন সিনেমা না বানিয়ে থাকতে পারে নাআর আরেকজন ক্রমাগত আঘাতের মুখে সিনেমার প্রতি ভালোবাসা হারাতে শুরু করেছে


          শুরুতেই একটা ভিডিওর কথা বলা হয়েছিল ভিডিওটি মোবাইল ক্যামেরায় রেকর্ড করা বৃদ্ধের অভিনয় প্রথমবার তা সিনেক্যামেরায় দেখা গিয়েছিলএবার খোদ মোবাইল ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলে ভিডিওটিতে বৃদ্ধের অভিনয় চলতে চলতে হঠাৎ দেখা যায় পানাহি তাঁর দুই অ্যাসিসট্যান্টকে নিয়ে সে দৃশ্য শুটিং করছেন তাঁদের শুট করা দৃশ্যই শুরুতে দেখেছেন দর্শকেরা পানাহি ভিডিওটিকে ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে দ্যানযেখানে আস্তে আস্তে সমুদ্রে নেমে যাচ্ছেন তিনি হঠাৎ পজ বাটন টেপেনএবং ভিডিওটিকে ব্যাকওয়ার্ড চালান মনে হয় তিনি যেন সমুদ্র থেকে ফিরে আসছেন সিনেমাটা শেষ হয় পানাহি যেভাবে এসেছিলেনসেভাবেই গাড়ি করে তাঁর চলে যাওয়া নিয়ে শুধু এবার তাঁর সিনেমার পোস্টার কোনো কাপড়ে ঢাকা থেকে না


          ক্লোজড কার্টেন’ একটি সম্পূর্ণ নতুন ঘরানার সিনেমা এখানে বাস্তবকল্পনা আর অতিবাস্তব ইচ্ছেমতো একে অপরের মধ্যে পাল্টাতে থাকে পানাহি আর সব কিছু ছেড়ে নিজের ইমেজকেই সবরকম নিষিদ্ধতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন সিনেমার পোস্টারের উপর থেকে কাপড় সরানোনিজের শ্যুটিং করার দৃশ্যকে প্লটে ঢুকিয়ে দেওয়ার মধ্যে সেই চ্যালেঞ্জ ঠিকরে পড়েযা চিরকাল সরকারী বাঘনখের সামনে শিল্পীকে অনমনীয় করেছে সিনেমাটিতে যেভাবে ‘সিনেমাকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছেতাও অসম্ভব আকর্ষণীয়


          ২০১০ সালে সরকারী নিষিদ্ধতা জারির পরপানাহি ‘দিস ইজ নট  ফিল্ম’ সিনেমাটি কেকে লুকিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়েছিলেন ‘ক্লোজড কার্টেন সরকারী রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বার্লিনে সিলভার বিয়ার জিতেছে তাই আমাদের দেশে চিত্রপরিচালকেরা যখন সরকারী নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে শিল্পকে গুটিয়ে নেনসেই শিল্পকে খেলো আর হাস্যকর মনে হয়