হাঙরের দাঁত
জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
যদি ধরে নেওয়া যায়, প্রতিটা মানুষের জীবন এক একটা ডায়েরি...
তাহলে কেমন হয়? ছোটবেলা থেকে এমন কত কিছুই তো ধরে নিতে
সেখানো হয়। আর আমরা সেই ধরাটাকে ধরে বসে থাকি, অঙ্ক কষতে
কষতে কখন সেই অধ্রুবর উত্তর মিলবে তার অপেক্ষায়। তেমনই ধরে নেওয়া সেই ডায়েরির কথা যদি ভাবা
যায়, তাহলে মনে
হয় তার প্রতিটা পাতা কেবলমাত্র অপরের নয়, মাঝে মাঝে সেই
ব্যক্তির নিজেরও কৌতূহলের উদ্রেক করে। কিছু পাতা খালি থাকে, খালিই থেকে যায়। কিছু পাতা হয় স্বচ্ছ। কিছু
পাতা হয় অর্ধস্বচ্ছ। কিছু পাতার হাতের লেখা, যে লিখেছে পরবর্তীকালে
সেই নিজেই চিনতে পারে না। আবার, কিছু পাতার লেখা দেখে স্পষ্ট
চেনা যায়, এ তার হাতের লেখা নয়... অন্য কেউ যেন তার অজান্তেই
কতকিছু লিখে রেখে গেছে। ডায়েরির কোনও পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিলেও, সেই জায়গায় একটা চিহ্ন থেকে
যায়। পাতা উলটোতে উলটোতে ঠিক সেইখানে এসে পৌঁছলে সেই ছেঁড়া দাগও জানান দিয়ে যায়,
যে এইখানে একসময় কেউ ছিল। আর এই ‘কেউ’-এর কথা যদি মনে থাকতে পারে, তাহলে সেই পাতায় কি ছিল,
তাও মনে থাকে বই কি!তবুও ওই পাতাটা ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়, তার উপস্থিতি অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে। এমন ডায়েরির পাতা নিয়ে যদি সত্যিই
অনুসন্ধান শুরু হয়, তাহলে দুনিয়ার সব সত্যান্বেষী মিলেও
বিশেষ সুবিধে করতে পারবে না। বোধহয় এই গোপনীয়তা, অনুপস্থিতি
বা পরোক্ষে থাকারও একটা নিজের স্থান আছে, যা সম্মান দাবি
করে। ছিঁড়ে ফেলা পাতাদের সেই শূন্যস্থানগুলোর প্রতি সেই সম্মান দেখিয়ে ময়নাতদন্ত
থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়াই শ্রেয়। ওই শূন্যের মাঝেই তারা আশ্রয় খুঁজে নিক।
একসময় শহরের বহু অঞ্চলে দুপুর হলেই শোনা যেত এক
বিশেষ সুর... সাপের বাঁশিরসুর। কেউ
অলিগলি দিয়ে সাপের বাঁশি বাজাতে বাজতে
চলে যাচ্ছে দুপুরের নিস্তব্ধতার বুকে একটা হালকা ঢেউ তুলে। তার এই চলে যাওয়াটা
তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। রাস্তার কুকুরগুলো ঘুমে আচ্ছন্ন থেকেও কেবল কান খাড়া করে একবার বোঝার চেষ্টা
করত সেই আওয়াজের উৎস। দৈবাত একবার মাথা তুলে আবার সেই মাথা ফেলে দিত ফুটপাথের ওপর।
যেসব বাধ্য ছেলেমেয়েরা দুপুর জেগে অঙ্ক করে, তারা হয়ত অবহেলার সাথে একবার
দেখত জানলার বাইরে। তারপর অ্যালজেব্রার ইকোয়েশনে হারিয়ে যেত সেই বাঁশির সুর।
কিন্তু সে সুর যেন খুঁজত কোনও আগ্রহী স্রোতাকে, যার কৌতূহল
তাকে বাধ্য করবে সেই বাঁশিওয়ালার সামনে এসে দেখতে… কেন সে অমন বাঁশি বাজিয়ে
যাচ্ছে এ পথ ধরে। কোনও না কোনও পাড়ার মোড়ে, মাঠের ধারে, বাজারের সামনে ঠিক এমন কৌতূহলী স্রোতা জুটে যাবে তার। কিন্তু তবুও যেন
ইচ্ছে করেই এই গুরুত্বহীন উপস্থিতিটা ঘুমন্ত দুপুরকে জানান দিয়ে যাওয়া। এমন
সাপের বাঁশি বাজিয়ে পথ ধরে হেঁটে গেছে অনেকে, তবুও ‘তারা’ না
বলে, সে বলে গেলাম। কারণ পরিচিতিটা সেই ‘সাপুড়ে’, পৃথক পৃথক চেহারা নেই কারও... সবাই এক।
এমনই একজন সাপুড়েকে দেখতাম আমাদের বাড়ির
কাছাকাছি একটা খেলার মাঠে আসতে মাঝে মধ্যে। আমরা থাকতাম শহরতলি অঞ্চলে। তখনও বহু
খেলার মাঠ ছিল, প্রোমটারেরা মুক্ত শৈশবের গলা টিপতে পারেনি। একবার ছুটির দিনে বেলার দিকে
সেই মাঠের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম, একটা জায়গায় বেশ কিছু লোক ভিড় করে আছে। গোল
হয়ে ঘিরে তারা কিছু দেখছে কৌতূহল ভরে। অত লোকের কৌতূহলের খোরাক আমার মনেরও খিদে
বাড়িয়ে দিলো। ছুটে গেলাম সেখানে, লোকজনের ফাঁক দিয়ে ভিড়ের
মধ্যে গলে গিয়ে দেখলাম একজন সাপুড়ে একটা লম্বা সাপকে সামনে ঝুলিয়ে ধরে এক নাগারে কিছু বলে চলেছে, আর লোকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে। আমার কানে
তার একটা কথাও ঢুকছিল না। আমি এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম তার হাতের সেই প্রাণীটির
দিকে। ল্যাজের একটা প্রান্ত তার হাতে ধরা, হাতটা উঁচু করে রাখা যাতে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করে। তার লম্বা শরীরের অপর
প্রান্ত এসে ঠেকেছে মাটিতে। মাটিতে যাতে মাথা ঠোকা না লাগে, যেন সেই জন্যই সাপটা জোর করে
নিজের মাথা তুলে রেখেছে খানিকটা ওপরে। মুহুর্মুহু চেরা জিভটা বেরিয়ে বাতাসের স্বাদ
নিয়ে যাচ্ছে। বিষ দাঁত ভেঙ্গে দেওয়ার প্রবাদটা আমি শুনেছিলাম। সেই সাপুড়ের হাতে
সাপটিকে সেদিন বড় অসহায় মনে হয়েছিল। বুঝেছিলাম, এ যতই লোকজনকে জ্ঞান দিক, হয় এই সাপ বিষধর নয়, আর নাহ’লে
বিষদাঁতের একটা কিছু ব্যবস্থা করা আছে। এরপরেও একাধিক বার তাকে দেখেছি সেই মাঠে। ভালোই পসার জমেছিল তার ওই অঞ্চলে। অচিরেই তাকে দেখা যেতে লাগল বিভিন্ন জায়গায় ভিড়
জমিয়ে খেলা দেখাতে। ভর দুপুরে সেই সাপের বাঁশি বাজিয়ে চলে যেত পাড়ার অলি-গলি দিয়ে।
সে সুর অবশ্য তার নিজের নয়, হিন্দি সিনেমা নাগিনের বীণ... হেমন্ত কুমারের সুর।
সাপ বা সাপের বাঁশি, যার টানেই হোক, যখনই সেই সাপুড়েকে দেখতাম, থমকে দাঁড়িয়ে পড়তাম। ইচ্ছে হ’ত একবার বলে দেখি সাপটাকে বার করতে, কিন্তু সাহস হ’ত না। পাড়ার চেনা কেউ দেখে ফেললে সে কথা বাড়ি অবধি
পৌঁছবেই, আর তা মোটেই সুখের নয়। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে অবশ্য সেই সুযোগ
অযাচিত ভাবেই এসে গেল। দেখলাম একটা বন্ধ দোকানের শাটারে হেলান দিয়ে সেই সাপুড়ে পা
ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।দেখে মনে হ’ল সারাদিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্ত হয়ে
ঘুমচ্ছে। তার পাশে রাখা কাপড়ের বড় ঝোলা, যার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে সেই পেট মোটা সাপের বাঁশি, আর একটা বেতের ঝুড়ির কিছুটা অংশ। তার ভেতরেই সেই প্রাণীটা চেরা জিব নিয়ে, তার প্রভুর মতই সারাদিনের ক্লান্তির পর বিশ্রাম নিচ্ছে। ছেলেমানুষি খেয়াল বলল“সাপুড়েটা ঘুমচ্ছে, এই ফাঁকে, একবার বাঁশিটা হাতে নিয়ে
দেখলে কেমন হয়।” এক পা এক পা করে সেইদিকে
এগিয়ে গেলাম। সেই সাপুড়েকে প্রথম কাছে থেকে লক্ষ্য করলাম।কানে
দুল, বা হাতে বালা অথবা উলকি, বা লম্বা চুল এমন কিছুই নেই… তাকে বেদে ভাবলে ভুল হবে। পরনে একটা মলিন শার্ট আর
সবুজ চেক লুঙ্গি। যেমন আমাদের সমাজে শ্রমজীবী মানুষের চেহারা হয়। শুধু মাথার চুলগুলো একটু
বেশি লালচে, বহুদিনের
অযত্নে যেমন হয়। তার ঘুম যাতে না ভাঙে, সন্তর্পনে এগিয়ে গেলাম সেই কাপড়ের ঝুলির দিকে। সামনের দিকে ঝুঁকে বাঁশিটা ধরতে
যেতেই সে এক চোখ খুলে বলল “কি খোকাবাবু? সাপ ধরবা?” আমি চমকে দু’পা পিছিয়ে গেলাম, আর এক পা পিছোলেই পেছনে নর্দমায় পড়ে যেতাম। সেই সাপুড়ে চকিতে আমার হাত
ধরে এক টান মেরে সামনের দিকে নিয়ে এলো। মনের মধ্যে একটা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও চেষ্টা করলাম
যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকতে। লোকটা আমার হাত ছাড়ল না। খয়েরের দাগ ধরা দাঁত বার করে হেসে বলল “কি খোকাবাবু… এহুনি নালায় পড়তা যে! ঝুলি থ্যাকে কি নিতে আইসিলে?” আমি অপ্রতিভ হয়ে বললাম “কোই, কিছু না তো…” সে সোজা হয়ে বসে, ঝুলি থেকে বাঁশিটা বার করে বলল “তাইলে আইসিলে ক্যান? আমি যে দ্যাখলাম এই বাঁশির দিকে তুমি হাত
বাড়াস্স…” আমি তাকে বাঁধা দিয়ে বললাম “ওই বাঁশিটা… হ্যাঁ, ওটাই একবার দেখব বলে…” সে সাপের বাঁশিটা মুখে দিয়ে একবার গালফুলিয়ে মুখভঙ্গি করল… তারপর লাল জিব বার করে হা হা করে হাসল। “বাঁশি নিয়ে কি করবা? বাজাতি পারবা?” আমার বাঁশি বাজানোর এতটুকু
ইচ্ছে ছিল না… এমনকি তার বাঁশি শোনারও ইচ্ছে ছিল না। কেবল হাতে নিয়ে দেখার ইচ্ছে
ছিল। আমার আসল কৌতূহলের বস্তু ছিল
সেই ঝুলির ভেতর ঢাকা দেওয়া বেতের ঝুড়ি। সে আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার আমার হাতটা খপ করে
ধরে বলল “দু’টাকা
দ্যাও, তাইলে বাজায়ে শোনাতি পারি।” প্যান্টের পকেটে খুচরো পয়সা ছিল, কিন্তু তবুও দিতে ইচ্ছে হ’ল না। এভাবে রাস্তায় হাত ধরে যে টাকা চায়, সে মোটেই
সুবিধের লোক নয়। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। পেছন থেকে সেই
সাপুড়ের গলার আওয়াজ ভেসে আসছিল “আরে ও খোকাবাবু... ডর লাগল
নাকি? হা হা হা হা...”
ভয় পাওয়ার মত তার চেহারায় কিছুই ছিল না। আরও
ছোট হ’লে হয়ত ওই
কাপড়ের বড় ঝুলিটা দেখে ছেলেধরা বলে ভয় পেতাম। কিন্তু তখন তাকে দেখে ভয় পাইনি
মোটেই। সেদিন সেই সাপুড়ে, ‘খোকাবাবু ভয় পেয়েছে’ বলে, বিদ্রুপ করায় বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। ঝুলিটার অত
কাছে গিয়েও সাপ বা সাপের বাঁশি কিছুই হাতের নাগালে এলো না। আর লোকটা স্পষ্ট জানালো
বাঁশি শুনতেও টাকা লাগবে! সেই সময় হাত খরচের টাকা দূরস্থ, কারও
দাক্ষিণ্যে হয়ত মাঝে মাঝে চার আনা, আট আনা বা দৈবাৎ এক টাকা
পাওয়া যেত। সেই টাকা জমিয়ে রাখা থাকত বছরের কোনও বিশেষ দিনে, কোনও বিশেষ সাধ মেটানোর জন্য, তা সে যত তুচ্ছই হোক। সেই সামান্য পুঁজি খরচ করে
বাঁশি শোনা মানে, অন্য একটা ইচ্ছা বিসর্জন দেওয়া। মনটা কেমন ভেঙ্গে গেল। ক’দিন ঘুমের মধ্যেও সেই বাঁশির আওয়াজ শুনলাম। এরপর বেশ কিছুদিন, পাড়া দিয়ে ওই সাপুড়ে বাঁশির আওয়াজ করে গেলেই মন চঞ্চল হয়ে উঠত বারান্দার
গ্রিল ধরে দেখতাম সে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ডাকতাম না, বাড়িতে
সাপুড়ে ডেকে আনলে কি হ’তে পারত, তা না
মনে করাই ভাল। কিন্তু
মনের মধ্যে একটা টান ছিলই... সে সাপের প্রতি, না সাপের বাঁশির প্রতি না সাপুড়ের প্রতি তা
ঠিক বুঝতাম না। কিছুদিন পরই ইচ্ছে হ’ল আবার একবার কথা বলে
দেখি। সেই মাঠের ধারেই একটা পার্কের ভেতর তার সাথে আবার দেখা হ’ল। দুপুরবেলা ওই পার্কে খুব একটা কেউ যেত না। পথ চলতি লোক মাঝে মাঝে কেউ
আসত বিশ্রাম করতে। অথবা ভবঘুরেরা বেঞ্চের ওপর পড়ে ঘুমত। সেই পার্কে বসে সে
পেয়াঁজ-মুড়ি খাচ্ছিল। এবারে সেই পেটমোটা বাঁশি তার পাশেই রাখা। বেতের ঝুড়িটাও
ঝুলির বাইরে। আমাকে কাছাকাছি আসতে দেখেই সে বিশ্রী রকম হেসে বলল “কি খোকাবাবু, সেদিন অমন পালালে ক্যান্? ভয় পাইলা নাকি?” আমি এই প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে
বললাম “ওই ঝুড়ির ভেতর কি আছে?” সে একই
রকম হেসে বলল “কালিয়া নাগ আসে! সুঁলেই ফোঁসসসসস!...” আমি সভয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম “আমি জানি, ওর বিষদাঁত ভাঙা।” সে
কিছুক্ষণ সুরমা লাগানো চোখে তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হেসে,
মাথা নেড়ে আবার মুড়ি খাওয়া শুরু করল। আমি আবার কিছুটা কাছে এসে বললাম
“তোমাকে দু’টাকা দিতে পারি... বাঁশি
বাজাতে হবে না, এই বাঁশিটা আমার হাতে দিতে হবে।” সে খাওয়া থামিয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল “কি?”,
তারপর আবার দাগধরা দাঁত বার করে হাসতে লাগল। আমি বেশ বিরক্তির সাথে
বললাম “এতে হাসির কি হ’ল, বললাম তো টাকা দেব।” বালকের অপ্রসন্নতা তার কৌতুক
বাড়াল বই কমাল না। সে বাঁশিটা বাঁ হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল, সেদিকে আমি হাত বাড়াতেই আবার পিছিয়ে নিল। এইরকম দু’তিন
বার হওয়ার পর আমার আর ওই হেনস্থা সহ্য হ’ল না। “দিতে হবে না যাও!” বলে সেখান থেকে ফিরে আসতে উদ্যত হ’তেই সে খাবার ছেড়ে উঠে পড়ে ছুটে এসে আমার হাত ধরল। তারপর বাঁশিটা হাতে
দিয়ে বলল “এই ন্যাও, কি দেখবা দেখো।
কিন্তু খবদ্দার! যদি উলটাপালটা সুর বাজে, তাইলে নাগরাজ চটি
যাবে... সে কেলেঙ্কারী কাণ্ড!” ঝুড়ির ভেতর সেই সাপের ঘুম
ভাঙ্গিয়ে কেলেঙ্কারী ঘটানোর কোনও অভিপ্রায় আমার ছিল না। কেবল সেই অদ্ভুত বাঁশিটা
একবার হাতে নিয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল বহুদিনের। প্রথমবার সেটা হাতে পেয়ে বেশ একটা
রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম। সেই বাঁশিতে কি কায়দায়, কেমন করে
ফুঁ দিলে অমন আচ্ছন্ন করা সুর বের হয় তার কিছুই জানি না। আমি সেটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
দেখে আনন্দ পাচ্ছিলাম, আর সেই সাপুড়ে আমাকে দেখে মজা
পাচ্ছিল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছুক্ষণ দেখার পর হঠাৎ সেই বাঁশি মুখে দিয়ে বাজানোর
চেষ্টা করলাম। ঠিক ওইভাবে মুখে দিয়ে মাথা দুলিয়ে, যেমন
সাপুড়েরা করে। কিন্তু তার থেকে সাপুড়িয়া বাঁসির সুরের বদলে যে শব্দ বেরোল, তাতে আমার নিজেরই হাসি পেয়ে গেল। সেই সাপুড়ে ছুটে এসে আমার হাত থেকে
বাঁশিটা কেড়ে নিয়ে বলল “বাজাতে মানা করসিলাম কি না!” আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম, “আমি কি বাজাতে পারি?
ফুঁ দিয়ে দেখছিলাম কেমন আওয়াজ... দোষ কোথায়?” সে
আমার শার্টের হাফ হাতার ফাঁকে কাঁধ থেকে খসে পড়া পৈতেয়ে একটা আলত টান দিয়ে বলেছিল “দোষ হেথায়।”
এরপর তার সাথে বেশ একটা ভাব জমে গেছিল। বাড়ির
কেউ কখনও জানেনি যে ওই সাপুড়ের সাথে আমার আলাপ আছে। অভিভাবকদের জেড়া সামলানো
সাবালকদের পক্ষেও বহুক্ষেত্রে নিদারুণ হয়ে ওঠে। নাবালকের পক্ষে তেমন পরিস্থিতি
এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কখনও বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে ইচ্ছে করেই
তাকে দেখা দিতাম না, পাছে সে চিনে ফেলে ‘কি খোকাবাবু!’ বলে হাঁক দেয়। তার সাথে কথা বলে জেনেছিলাম তার নাম সুলেমান, দিনাজপুরের লোক। সে দিনাজপুর উত্তর না দক্ষিণ, নাকি
ওপার বাংলার তাও বুঝিনি তখন... শুধু জানতাম সুলেমানের দেশ দিনাজপুর। সাপখেলা
দেখানো সে শিখেছে তারা বাবার থেকে। যদিও তারা বেদে নয়, সাপ
নিয়ে কারবারও করে না। চাষের সময় জমিতে ভাগচাষীর কাজ করে, আর
অন্যসময় শহরে ভেসে বেড়ায় কিছু না কিছু কাজে। শহরে কেবল সাপের খেলাই দেখাত এমন নয়।
কোথাও দিনমজুর লাগলে সেখানেও চলে যেত। সে থাকত সেই মাঠ থেকেই অল্প দূরে একটা
বাজারের পেছন দিকে... একটা ছোট বস্তিতে। সে বস্তির বেশির ভাগ বাসিন্দাই আসলে সেই
বাজারের ছোটখাটো দোকনদার অথবা সেই অঞ্চলের রিকশাচালক বা ঠিকে ঝি। তাদেরই মাঝে একটা
ছোট ঝুপরিতে থাকত সুলেমান, তার অদ্ভুতদর্শণ বাঁশি আর তার
নাগরাজ। আমার সঙ্গে ব্যক্তি সুলেমানের কোনওদিনই কোনও নিবিড় সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয়
না। কিন্তু একটা অদ্ভুত কৌতূহল যে ছিল, তাও অস্বীকার করতে
পারি না। আমি তার সাথে বসে থাকতাম দেখার জন্য, কখন সে ঝুড়ির
ঢাকা তুলে ওই সাপটাকে বের করে। সেই সাপের মুখের মধ্যে একটা নল গুঁজে তাকে এক
অদ্ভুত কায়দায় কাঁচা ডিম খাওয়াত, আমি অবাক হয়ে সেই সাপের
খাওয়া দেখতাম। ইচ্ছে থাকলেও সেই সাপের গায়ে হাত দেওয়ার মত সাহস আমার একেবারেই
হয়নি। দু’হাতে সেই প্রাণীটিকে ধরে খেলার ছলে মাঝে মাঝে আমার
দিকে এগিয়ে দিলে আমি সভয়ে লাফ মেরে দূরে সরে যেতাম, সুলেমান
হা হা করে তার লাল টকে টকে জিব বার করে হাসত। সেই সাপ কি জাতের, কোথা থেকে ধরেছে এইসব বিষদে কখনও জানতে চাইনি, আর সে
বলে থাকলেও আমার মনে নেই। কেবল তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম “এই নাগরাজ যদি মরে যায়, বা হারিয়ে যায়... তাহলে তুমি
কি করবে?” সেই সাপের মাথার কাছে বাঁশির একটা দিক নিয়ে গিয়ে
তার সাথে খেলতে খেলতে সুলেমান বলেছিল “এক নাগরাজ যায়,
আর এক নাগরাজ আসে... এক সুলেমান যায়, আর এক
সুলেমান আসে... বাঁশি থেমে থাকে না।”
সুলেমান বছরের একটা বিশেষ সময়েই আসত। ঠিক বর্ষার শেষে তাকে দেখা
যেত, আর শীতের
শুরুতেই সে চলে যেত। এইভাবে চার-পাঁচ বছর কেটে গেল। আমি কৈশরে পদার্পন করলাম।
ছোটবেলার সেই বালকোচিত সখগুলো একটা একটা করে মুছে গিয়ে তার জায়গায় নতুন ইচ্ছের বীজ
অঙ্কুরিত হ’তে লাগল। সেই সাপের বাঁশির সুরের মায়াও ক্রমে
ফিকে হয়ে এলো, তার জায়গা নিল তৎকালীন প্রচলিত হিন্দি গানের
সুর। সুলেমান তখনও আসত। তখনও বন্ধুদের সাথে স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখতাম পার্কের
কোনও একটা বেঞ্চে সুলেমান বসে আছে তার কাপড়ের ঝুলি নিয়ে। আমাকে দেখলে সেই আগের মতই
দাগধরা দাঁত বার করে হাসত, “কি খোকাবাবু! ইশকুল থেইকা ফিরস?”
বলে হাঁক দিত। আগের মত আর তার সাথে বসে বেশিক্ষণ কথা বলা হ’ত না। কিন্তু, তখনও সুযোগ পেলে ওই সাপকে ডিম খাওয়ানো
দেখতে যেতাম তার কাছে। বাইরের লোকের সামনে একমাত্র খেলা দেখানোর সময় ছাড়া সে
সাপটাকে বিশেষ বার করত না। কেবল আমিই সুযোগ পেতাম ওই সাপকে অত কাছ থেকে দেখার।
তাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম “এই সাপটা কি সেইটাই? যেটা পাঁচ বছর আগে দেখেছিলাম? এখনও বেঁচে আছে?”
সুলেমান তার স্বভাবোচিত হাসি হেসে বলত “ওরেই
জিগাও না... দেখো তোমারে চেনে কি না!”
এই সুলেমানের সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎটাও বড়
অদ্ভুত। আর হয়ত সেই জন্যই আজ এত বছর পরেও তার কথা মনে থেকে গেছে। তখন আমার বয়স পনেরো কি ষোলো।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখলাম বাজারের দিকটা বেশ ভিড় জমে আছে। এমন ভিড় অসময়ে
বাজারের দিকে হয় না। দেখেই বুঝলাম ব্যাপার সুবিধের না। বন্ধুদের আপত্তি অগ্রাহ্য
করে গিয়ে দেখলাম ভিড়টা ক্রমশ ঘন হয়েছে বসতির দিকে... এও একরকম তামাশা দেখার ভিড়।প্রজন্মের
পর প্রজন্ম মানুষ এইভাবে তামাশা দেখার জন্যই ভিড় জমায়। মজা ফুরিয়ে গেলে, আবার ভিড় পাতলা হয়ে যায়। বসতির
সামনে দেখলাম একটা পুলিশের জিপও দাঁড়িয়ে আছে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখলাম তিন চারজন
উর্দি পড়া পুলিশ সেখানে লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাদের একজনের হাতে একটা হাতকড়া,
যার অপর প্রান্ত সুলেমানের হাতে বাঁধা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে
সে। তার পরনের জামাটা ছেঁড়া, চোখমুখ ফুলে আছে। তাদের অনতি
দূরেই একটা সাপের থ্যাঁতলানো দেহ, তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা
হয়েছে। আর একটা সাইকেল ভ্যানের ওপর চাদর চাপা একটা লাশ, যার
মাথার কাছে লাল ভিজে অংশ থেকে বোঝা যায় তার মাথার অবস্থাও ওই সাপটারই মত।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুলেমানকে টেনে পুলিস জিপে নিয়ে গিয়ে বসাল। সেই ভিড়ের মধ্যেও
আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সুলেমানের সাথে আমার চোখাচুখি হয়ে গেল। সে যেন আমাকে
শুনিয়েই ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলল “বিশ্বাস করেন বাবু... ও
সাপে বিষ নাই... ও সাপের বিষ হয় না... তাও ওরে বাঁচতে দিলে না...”। পুলিসের জিপ চলে যাওয়ার পর ভিড় ক্রমে পাতলা হয়ে এলো।
উপস্থিত জনতার কাছ থেকে শুনলাম বিষধর সাপ নিয়ে বস্তিতে থাকা নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ
এক মাছওয়ালার সাথে সুলেমানের বাগবিতণ্ডা চলছিল। আজ সকালে নাকি মদ্যপ অবস্থায় সেই
মাছওয়ালা সাপটাকে ঝুড়ি থেকে বার করে মাথায় থান ইঁট দিয়ে মেরে ফেলে। মাতাল সাপ
মারতে সক্ষম ছিল, আত্মরক্ষা করতে নয়। সুলেমান মাথার ঠিক রাখতে না পেরে সেই থান ইঁটই সেই
মদ্যপের হাত থেকে কেরে তার মাথায় বসিয়ে দেয়। আসতে আসতে এগিয়ে দেখলাম সুলেমানের
ঝুপরিটা পুলিস সিল করে দিয়ে গেছে... দরজায় অসম টিনের পাল্লার তলা দিয়ে উঁকি মারছে
সেই পেট মোটা বাঁসিটা। এই বাঁশি তো আর খুনের এক্জিবিট নয়, তাই
তার প্রতি কারও নজর পড়েনি। আর কালবিলম্ব না করে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে এলাম। পথে
সুলেমানের সেই কথাটা মনে পড়ছিল “এক নাগরাজ যায়, আর এক নাগরাজ আসে... এক সুলেমান যায়, আর এক সুলেমান
আসে... বাঁশি থেমে থাকে না।”
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। সুলেমানকে, তার সাপের ঝুলি সমেত অনেক অনেক
দূরের কোনও স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে এসেছি। সেই সাপের বাঁশির সুরও ফিকে হয়ে গেছে। সেই
আট আনা, এক টাকা জমিয়ে ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো পূরণ করার স্বপ্ন
দেখা খোকাবাবুও হারিয়ে গেছে। হয়ত সময়ের সাথে সাথে এইভাবেই একটা একটা করে সব কিছু
সরে যায়, আর নতুন কিছু এসে সেই শূন্যস্থান পূরণ করে দেয়।
আমরা সেই নতুন ইচ্ছে, নতুন আকাঙ্ক্ষা, নতুন
চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের মাঝে কিছু জিনিস ভুলে থাকি, কিছু জিনিস
ভুলে থাকার চেষ্টা করি। সুতরাং এত বছর বাদে, ভিন রাজ্যে
হাজার ঝামেলার মাঝে সুলেমানের মত একটা তুচ্ছ মানুষের অস্তিত্ব যে গুরুত্ব পাবে না,
এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ডায়েরির পাতাগুলো আছে, তার লেখাগুলো আছে... সে সব যাবে কোথায়? কিছুদিন আগে,
এক রবিবার দুপুরে হঠাৎ বাড়ির সামনের রাস্তায় সাপের বাঁশির শব্দ
শুনতে পেলাম। মনে হ’ল একটা হালকা হাওয়া ডায়েরির পাতাগুলো
উলটে উলটে পেছন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই সুর আমার পরিচিত নয় মোটেই, মনে হ’ল দক্ষিণ ভারতীয় কোনও গানের সুর। কিন্তু
বুঝলাম, যন্ত্রটা সাপের বাঁশি ছাড়া আর কিছুই নয়। বাইরে এসে
দেখলাম গেটের সামনে রাস্তার ওপর কেউ ওই বাঁশি বাজাচ্ছে। আর তার সাথে একটি ছোট মেয়ে
হাতে একটা বেতের ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে সেই লোকটি আরও
উৎসাহের সাথে বাজাতে লাগল। কাছে গিয়ে দেখলাম, সেইরকম পেটমোটা
সাপের বাঁশিই বটে। আর বেতের ঝুড়িতে একটা সাপ ঝিম মেরে কুন্ডুলি পাকিয়ে পড়ে আছে,
তার আসে পাসে খুচরো পয়সা। বুঝলাম এরা সাপের খেলা দেখাতে বেরোয়নি,
নাগ দেবতার নামে প্রণামী তুলতে বেরিয়েছে। এদেশে অনেকেই এইভাবে
জীবিকা নির্বাহ করে। লোকটার কাছাকাছি যেতে সে নিজের ভাষায় ঝুড়িটার দিকে দেখিয়ে বেশ
বিনয়ের সাথে কিছু বলল, বুঝলাম টাকা দিতে বলছে। কিন্তু প্রায়
যন্ত্রচালিতের মত, আমার ডান হাতটা এগিয়ে গেল সেই বাঁশিটার
দিকে। ঠিক সেইরকম বাঁশি! লোকটি হাসি মুখে বিনা বাঁধায় বাঁশিটা আমার হাতে তুলে
দিলো। যেন নিজের মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই তাকে স্পর্শ করে অনুভব করার চেষ্টা
করলাম, পূর্বপরিচিত সেই স্পর্শ ফিরে আসে কিনা। দু-এক বার
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আবার ফিরিয়ে দিলাম, বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে
দেখার বয়স আর নেই। সেই ছোট মেয়েটি বেতের ঝুড়িটা আমার দিকে তুলে ধরেই দাঁড়িয়ে ছিল। দেখলাম সাপটা চোখ খুলেই পড়ে
আছে, তার গলার
কাছে নরম চামড়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্রুত ওঠা নামা। সেই সাপের নির্জীব চোখের থেকে
ছোট মেয়েটির চোখে জীবনের ভাগ বেশি। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে একটা দশ টাকার নোট বার
করে ঝুড়িতে রাখতে গিয়ে, সাপের গায়ে হাত ঠেকে গেল। দ্রুত সেই
হাত সরিয়ে নিলাম, কিন্তু সাপটার মধ্যে এতটুকু প্রতিক্রিয়া
দেখলাম না। তারা আবার বাঁশিতে সুর তুলে রাস্তা ধরে দূরে এগিয়ে গেলো। আমি গেটের
সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম তাদের সেই চলে যাওয়া। সুলেমান, সুলেমানের
পেটমোটা বাঁশি, কাপড়ের ঝুলি... আর সেই সাপটা, যার বিষ ছিল কি ছিলনা তা কেবল সে নিজেই জানত। সুলেমানের সাথে কখনওই কোনও
নিবিড় সম্পর্ক ছিল না, তবুও... আবার এক ঝলক বাতাসে ডায়েরির
পাতাগুলো ফরফর করে উঠল। চারাপাশে সব কিছুই কেমন হাঙরের দাঁতের মত। আসলে আমরাও এক একটাহাঙরের দাঁত!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন