১৪ অক্টোবর ২০১৪

গল্প-অশোক মজুমদার



চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই

অশোক মজুমদার

চুন্নির শিফন শাড়িটা জৌলুস হারিয়েছে ।তবুও সেটাই পড়েছে সে ।সিমাইয়ের পাত্রটিতে চাঁদের আলো পড়েছে ,তাতে চিনি জল দিয়ে ফোটানো সুজির আঠা লেগে ।তাই খেয়ে ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে । চুন্নি শিকল তুললো সাবধানে ,পাছে ছেলের ঘুম ভেঙে যায় ।তবু ভেজানোর সময় ক্যাঁচচ করে দরজাটা আওয়াজ করল ।
Factory
র গেটে দুটো টানটান ব্যানারে দাবী দাওয়া লেখা । তার পাশে চোলাইয়ের গলি ।চুন্নি এখন সে গলি দিয়ে হেঁটে যাবে ,আস্তে আস্তে ।হাঁটু মুড়ে ড্রেনের পাশে বসে ,অথবা বুঁদ হয়ে রাস্তায় শুয়ে লোকগুলোর চোখ ঘেঁষে ।লোকগুলো তাকে দেখে সুরুৎসুরুৎ করবে তাদের নোলা ।তার বুকের খাঁজে চাঁদের আলো পড়বে আর একটা সরু আঁধারী গলির মতো সে খাঁজ দেখা যাবে না ।দেখতে চাইলে পয়সা লাগবে ।পয়সা লাগবে চুন্নির তার ছেলের জন্য ঈদের খুশি কিনতে ।
আঁধারে আরো আঁধারে গিয়ে চুন্নি দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো ।পানের পিকে লাল কাদাময় সে দেওয়াল ।চোলাই আর প্রস্বাবের গন্ধময় স্যাঁতসেঁতে ।চাঁদের আলো এড়িয়ে গিয়েছে এ অন্ধ নেশাতুর যৌনগলি ।গলিটিকে দুধারের দুটি বন্ধ কারখানার উঁচু দেওয়াল আকাশের শীর্ণ সরু রেখা বই কিছু দেখতে দেয় না ।বৃষ্টির মন ভরেনা এ গলিতে ।চারপাশের বৃষ্টির জল এ গলি দিয়ে হু হু করে বয় । পঙ্কিল নর্দমা উপচে গলিটিই যেন আস্ত নর্দমা ।গলিটি ঝলমলে দিনও দেখে না । সূর্যালোক ভিখিরির মতো গলিটিকে চিলতে রোদ ,দেওয়ালের মাথায় ছুঁড়ে দিয়ে বলে ,'মাফ করো ।'
অন্ধকারে আবছায়ার মতো খদ্দের এলো বোধহয় । চুন্নি তটস্থ ,প্রস্তুত করে নিজেকে গলিত কঠোর দর কষাকষির ।লোকটি খুব কাছে আসতেই চুন্নি লজ্জা ,শঙ্কায় বিবর্ণ হয়ে পড়ে ।এ যে সুনীলদা ।ঝটিতে চুন্নি গলি থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতে,সুনীল তার হাত টেনে ধরে ।
-
দাঁড়া ,বলে সে টানা হাতেই তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে গলি থেকে দ্রুত ।রাস্তায় বেরিয়ে সে চুন্নির হাত ছেড়ে দেয় ।দুজন নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে বাড়ির দিকে ।চুন্নি চোখ মুছতে থাকে ঘন ঘন ।
চুন্নির বাড়ির দরজায় এসে সুনীল পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করে গুঁজে দেয় আর বলে ,"ওখানে যাস না রে ।" কথা সরে না চুন্নির কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ।ছেলে তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ।ঘরটি বাতিহীন হলেও ঝলমলে চাঁদের আলো কার্পন্য করে না ।একফালি এসে পড়েছে চুন্নির ছেলের কপালে ,কোঁকড়া চুলের উপর ।
চালের ড্রামের তলানির চালে ডুবিয়ে রাখা একখানিই কুড়িটাকার নোট একটু ঘাঁটতেই হাতে ঠেকে চুন্নির ।এ টাকাটা কাল তহমিনা তাকে দিয়েছে ।এটা তার স্বামীর টাকা ।'ছেলেটাকে একটু সেমাই খাওয়াস রে চুন্নি; ওর বাপেরই টাকা । কাল আমার ঘরে ছিলো মিনসে ।' --যখন বলেছিলো তহমিনা তখন ঘেন্নাই তেমনই চুপ করেছিলো চুন্নি যেমনটা আজ সুনীলদার থেকে টাকা নেওয়ার সময় লজ্জায় ।
'
টাকা' লজ্জা ,ঘেন্নার ধার ধারে না ।টাকায় লজ্জা,ঘেন্না,দায় ,ভালোবাসা ,আদর ,এমনকি আশীর্বাদও মিশে থাকতে পারে ।অনায়াসে লজ্জার টাকা আর ঘেন্নার টাকা মিলে সত্তর টাকা হয় ।
চুন্নি সে টাকা দিয়ে হাফ লিটার কেরোসিন তেল ,একটা সিমাইয়ের প্যাকেট ,হাফ লিটার দুধের প্যাকেট আর অল্প করে ভাঙা কাজু ,কিসমিস নিয়ে আসে ।।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন